আলুর সংকট নেই, অসাধু ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে দাম বাড়াচ্ছে: হিমাগার সমিতি
রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি ভালো মানের সাদা আলু ৪৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বগুড়ার লাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে।
হিমাগারের মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিসিএসএ) বলেছে, দেশে আলুর কোনো সংকট নিই। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করে আলুর দাম বাড়াচ্ছে।
রোববার দুপুরে রাজধানীর পুরানা পল্টনে বিসিএসএ অফিসে এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, আলুর কোনো সংকট নেই। বর্তমানে দেশের হিমাগারগুলোতে যে পরিমাণ আলু সংরক্ষিত রয়েছে, তা দিয়ে আগামী ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বাজারে আলু সরবরাহ করা সম্ভব হবে। ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে নতুন আলু বাজারে আসবে। ফলে বাজারে আলু সরবরাহের কোনো ঘাটতি হবে না।”
তিনি অভিযোগ করেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজি করে আলুর দাম বাড়াচ্ছেন।
সংবাদ সম্মেলনে মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানান, আলু উৎপাদন ও সংরক্ষণের বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি তথ্যে বড় ফারাক রয়েছে।
তিনি বলেন, “আমাদের জানামতে, দেশে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৮৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি আলু উৎপন্ন হয়নি। অথচ বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে ১ কোটি ১২ লাখ টন আলু উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন। এ বিবেচনায় সরকারি হিসাবে তো আলু উদ্বৃত্ত থাকার কথা”
কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে হিমাগারগুলোতে ২৩ লাখ ১২ হাজার টন আলু সংরক্ষণ হয়েছে। অথচ কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যে ২৪ লাখ ৯২ হাজার টন আলু সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, “এ মৌসুমে দেশের হিমাগারগুলোতে ২০ শতাংশ সংরক্ষণের স্থান ফাঁকা রয়েছে। আলু যদি বেশি উৎপন্ন হয়ে থাকে, তাহলে ধারণক্ষমতার ২০ শতাংশ জায়গা কেন অব্যবহৃত অবস্থায় রয়েছে? হিমাগার ফাঁকা থাকার কারণ, এ বছর আলুর উৎপাদন ও মজুত উভয়ই কম হয়েছে।”
“এখনো যে পরিমাণে আলু মজুত রয়েছে, তা দিয়ে আগামী মৌসুমের (ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ) আগপর্যন্ত আলুর কোনো সংকট হবে না।”
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, রোববার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি আলু মানভেদে ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
তবে রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, প্রতি কেজি ভালো মানের সাদা আলু ৪৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বগুড়ার লাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজি দরে।
সংবাদ সম্মেলনে সমিতির সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী আরও বলেন, ২০২৩ সালের মে মাসের ২০ তারিখের পর থেকে যখন আলু খালাস হওয়া শুরু হয়, তখন হিমাগার শেডে কাঁচা আলুর মূল্য ছিল প্রতি কেজি ২৬-২৭ টাকা। এই দরেই প্রকারভেদে আলু বিক্রি শুরু হয়েছিল।
“তবে আজ (রোববার) পর্যন্ত সেই দাম (হিমাগার শেডে) বেড়ে ৩৪ থেকে ৩৬ টাকা হয়েছে; অর্থাৎ মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম বেড়েছে কেজিতে ১০ টাকা।”
‘এই মূল্যবৃদ্ধি ‘কাঙ্ক্ষিত নয়’ উল্লেখ করে মোস্তফা আজাদ বলেন, “যারা আলু সংরক্ষণ করেছেন, তাদের অনেকে মনে করছেন, আলুর মজুত কম রয়েছে। সে জন্য তারা আলুর মূল্যবৃদ্ধি করে চলেছেন।”
কম চাষের কারণ লোকসান
কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেন, বিগত বছরগুলোতে কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীরা সঠিক মূল্য না পাওয়ায় ক্রমাগত লোকসানের মুখে পড়েছেন। এ ছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গম, ভোজ্য তেল ও ভুট্টার দাম বাড়ায় অনেক আলুচাষি এসব পণ্য চাষে ঝুঁকেছেন। এসব কারণে স্বাভাবিকভাবে আলু চাষ ও উৎপাদন কম হয়েছে।
“অন্যদিকে ২০১৩ সাল থেকে পরবর্তী কয়েক বছরে চাহিদার উদ্বৃত্ত আলু উৎপাদন হওয়ায় তা কম দামে বিক্রি করে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ী এবং হিমাগারের মালিক লোকসানে পড়েন। এতে অনেক হিমাগার ব্যবসায়ী ঋণখেলাপি হয়ে যান।”
“ফলে বর্তমানে খুব কমসংখ্যক হিমাগার ব্যবসায়ী নিজেরা আলু কিনে সংরক্ষণ করেছেন। সে ক্ষেত্রে আলুর অস্বাভাবিক দাম বাড়ার জন্য হিমাগারের মালিকদের দায়ী করা ঠিক হচ্ছে না।”
আলুর মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি সমিতিভুক্ত নন, এমন অসাধু কিছু হিমাগারের মালিকেরও দায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন মোস্তফা আজাদ চৌধুরী।
দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে
সংবাদ সম্মেলনে মোস্তফা আজাদ আরও বলেন, “কারা আলুর দাম বৃদ্ধি করছে, কারা সিন্ডিকেট করে আলু মজুত করছে... তাদের তথ্য আমরা সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে দিয়েছি। এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেও জানিয়েছি। এখন আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।”
“আলুর দাম বাড়ায় হিমাগার মালিকদের একতরফা দোষারোপ করা হচ্ছে এটা সঠিক নয়। সরকার আলু মজুতের যে তথ্য দিচ্ছে তা সঠিক নয়। কারণ প্র্যাকটিক্যালি আমরা দেখছি কোল্ড স্টোরেজের ২০ শতাংশ খালি রয়েছে।”
তিনি বলেন, “অসাধু ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে আলু ছাড়ছে। এর ফলে খোলা বাজারে আলুর দাম বাড়ছে। কেন দাম বাড়ছে সেটি সরকারের সংস্থাগুলোকে আমরা বলেছি। এই দাম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে তা সরকারকে ভেবে-চিনতে করতে হবে।”
“ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বা হয়রানিমূলকভাবে দাম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি যে, যারা অতি মুনাফার জন্য আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।”
কমেন্ট