বস্তার ওপর মিলের নাম, চালের দাম ও জাত অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, “আমরা সারা দেশে অভিযান চালিয়ে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে দেশে চালের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। নতুন সরকারকে বিব্রত করতে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।
বাজারে চালের দামের লাগাম টেনে ধরতে বস্তার ওপর মিলের নাম, দাম ও জাত উল্লেখ করতে হবে। বুধবার ছুটির দিনে এই আদেশ জারি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। তবে সরকারের এই নির্দেশ কার্যকর হবে আগামী ১৪ এপ্রিল থেকে; ওই দিন থেকে বাধ্যতামূলকভাবে মানতে এ নির্দেশ হবে।
দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের দাম এবার আমনের ভরা মৌসুমেও চড়ে উঠে। গত ৭ জানুয়ারির ভোটের পরপরই চালের দাম কেজিতে অন্তত ৫-৬ টাকা মিলগেটেই বেড়ে যায়। মাঝে প্রশাসনের অভিযানে এক-দুই টাকা কমলেও গত দুই দিনে তা বেড়ে ফের আগের জায়গায় উঠেছে।
রমজান সামনে রেখে সরকার শুল্ক কমানোর পরও তার প্রভাব পড়েনি চালের দামে; উল্টো বেড়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন থাকায় সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বুধবার প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর প্রকাশ করেনি। আগের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবারের টিসিবির দর অনুযায়ী, রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে এই চাল ৪৮ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মাঝারি মানের চাল ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা থেকে কমে ৫০ থেকে ৫৬ টাকা বিক্রি হয়েছে।
আর সরু চাল (মিনিকেট ও নাজিরশাইল) বিক্রি হয়েছে ৬৫ থেকে ৭৮ টাকায়। এক সপ্তাহ আগে এই চালের দাম ছিল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার, হাতিরপুল ও শেওড়াপাড়া বাজারে বুধবার টিসিবির দামের চেয়ে এই তিন ধরনের চাল কেজিতে ২/৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এ পরিস্থিতিতে চালের দাম কমাতে নানা উদ্যোগের পাশপাশি বস্তার ওপর মিলের নাম, চালের দাম ও জাত উল্লেখ করার আদেশ দিয়েছে সরকার।
বুধবার খাদ্য মন্ত্রণালয় এক পরিপত্র জারি করে বলেছে, উৎপাদনকারী মালিকেরা (মিলার) যখন গুদাম থেকে চাল বের করবেন, তার আগে বস্তার ওপর উৎপাদনকারী মিলের নাম, জেলা ও উপজেলার নাম, উৎপাদনের তারিখ, মিলগেটের দাম এবং ধান বা চালের জাত উল্লেখ করতে হবে। তবে এসব তথ্য কালি দিয়ে হাতে লেখা যাবে না। বস্তার ওপর এসব তথ্য মুদ্রিত থাকবে।
পরিপত্রে বলা হয়, সম্প্রতি দেশের চাল উৎপাদনকারী কয়েকটি জেলা পরিদর্শন করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, বাজারে একই জাতের ধান থেকে উৎপাদিত চাল ভিন্ন ভিন্ন নামে ও দামে বিক্রি হচ্ছে। চালের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে গেলে বা হঠাৎ বাড়লে মিলার, পাইকারি বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা একে অপরকে দোষারোপ করছেন। এতে ভোক্তারা ন্যায্যমূল্যে পছন্দমতো জাতের ধান, চাল কিনতে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন।
“অনেক ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্তও হচ্ছেন। এ অবস্থার উত্তরণের জন্য চালের বাজারমূল্য সহনশীল ও যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে, ধানের নামেই যাতে চাল বাজারজাতকরণ করা হয়, তা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে এবং এ–সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিবীক্ষণের সুবিধার্থে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে বলা হয়, চাল উৎপাদনকারী সব মিলমালিকের (অটো/হাস্কিং) সরবরাহ করা সব ধরনের চালের বস্তা বা প্যাকেটের (৫০, ২৫, ১০, ৫, ২, ১ কেজির ইত্যাদি) ওপর ওই তথ্যগুলো মুদ্রিত থাকতে হবে। করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও একই নির্দেশনা মানতে হবে।
“এ ক্ষেত্রে মিলগেট দামের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান চাইলে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য উল্লেখ করতে পারবে।”
পরিপত্রের আলোকে সব জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ও খাদ্য পরিদর্শকেরা পরিদর্শনের সময় এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করবেন।
এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না করা হলে খাদ্য দ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন, (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন ২০২৩ এর ধারা-৬ ও ধারা-৭ অনুযায়ী শাস্তি নিশ্চিত করা হবে বলে পরিপত্রে বলা হয়েছে।
ধারা-৬ এর অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার সুযোগ রয়েছে। ধারা-৭ এর শাস্তি হিসেবে রয়েছে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড অথবা ১৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয়দণ্ড।
গত ৬ ফব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় সভায় চালের বস্তায় এ সব তথ্য লেখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়।
ওইদিন সভার পর খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছিলেন “বস্তার গায়ে মিলগেটের দাম, ধানের জাত এবং উৎপাদন তারিখ উল্লেখ করতে হবে। এতে মিলগেটের দর জানতে পারবেন ক্রেতারা।”
ওই সিদ্ধান্তের ১৬ দিন পর পরিপত্র জারি করল সরকার।
পরিপত্রে বলা হয়, করপোরেট প্রতিষ্ঠান চাইলে চালের বস্তায় মিলগেট মূল্যের পাশাপাশি নিজস্ব সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য-এমআরপিও বসাতে পারে। ৫০ কেজি থেকে শুরু করে ২৫ কেজি, ১০ কেজি, ৫ কেজি, ২ কেজি ও এক কেজির প্যাকেট করা যাবে।
চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে গত প্রায় একমাসে সারাদেশে তিন হাজার ৩৮০টির মতো অভিযান পরিচালনা করেছে খাদ্য অধিদপ্তর, ভোক্তা অধিকারসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এসব অভিযানে জরিমানা আদায় করা হয়েছে কেটি টাকার বেশি।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রসঙ্গে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) এএইচএম সফিকুজ্জামান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমরা সারা দেশে অভিযান চালিয়ে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে দেশে চালের দাম বাড়ার কোনও কারণ নেই। নতুন সরকারকে বিব্রত করতে চালের দাম বাড়ানো হয়েছে। অসাধু মিলমালিক চক্র ডিসেম্বরের পর হঠাৎ করে চালের দাম বাড়িয়ে দেয়। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সারা দেশে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।”
একইসঙ্গে বস্তার ওপর মিলের নাম, চালের দাম ও জাত উল্লেখ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যে বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সেই বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম। সার্বিক বিষয় বিবেচনায় নিয়েই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করছি ভালো ফল পাওয়া যাবে।”
কমেন্ট