মূল্যবৃদ্ধির জন্য দায়ী চাঁদাবাজি ও ডলার, বললেন ব্যবসায়ীরা
এফবিসিসিআই পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ বখতিয়ার বলেন, “রাস্তায় পুলিশ চাঁদাবাজি করে, শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি হয়, বাজারে চাঁদাবাজি হয়, সব জায়গায় চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদাবাজি বন্ধ না করলে দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব না।”
রমজান মাস শুরুর আগেই আরেক দফা বেড়েছে বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম। আরও বাড়তে পারে—তা নিয়ে চিন্তায় আছেন দেশের মানুষ। বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য ব্যবসায়ীরা মূলত দুটি কারণের কথা বলেছেন। এর একটি রাস্তায় পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজি; আরেকটি ডলারের অস্বাভাবিক দর।
রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে বুধবার দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই আয়োজিত মত বিনিময়ে এ কথা বলা হয়।
রাজধানীর মতিঝিলের ফেডারেশন ভবনে সেই আলোচনায় কারওয়ানবাজার পাইকারি কাঁচাবাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সুজন চৌধুরী বলেন, “ড্রাইভাররা আমাদের সাথে শেয়ার করে, মাল আনার সময় পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা দেওয়ার জন্যই পণ্যের দাম বেড়ে যায়।”
“পরে সরবরাহকারীরা পাইকারি বাজারে মাল একটু বেশি দামে দেয়। এরপর পাইকারি দোকানির কাছ থেকে খুচরা দোকানিরা যে দামে কিনে তার চেয়েও অধিক লাভ করে। এভাবেই ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যায়।”
এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ বখতিয়ারও সড়কে চাঁদাবাজির প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, “রাস্তায় পুলিশ চাঁদাবাজি করে, শ্রমিক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি হয়, বাজারে চাঁদাবাজি হয়, সব জায়গায় চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদাবাজি বন্ধ না করলে দ্রব্যমূল্য কমানো সম্ভব না।”
সভাপতির বক্তব্যে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “আমাদের দেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে সরবরাহ চেইন। আমার মাল যেটা বিদেশ থেকে আসবে, সেটা যেন ঠিকভাবে সারাদেশে সমানভাবে পৌঁছায়। যদি না পৌঁছায় তাহলে কৃত্রিম সংকট তৈরি হবে। আমার মূল বক্তব্য একটাই। কেউ যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে।”
পাইকারির তুলনায় চেয়ে খুচরা পর্যায়ে মুনাফা অনেক বেশি জানিয়ে তিনি বলেন, “আপনারা নজর রাখবেন কেউ যেন অতি মুনাফা করতে না পারে।”
রোজার শুরুতে চাহিদা অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার কারণে দাম বাড়ে জানিয়ে এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, “ক্রেতাদের অনুরোধ করব যতটুকু প্রয়োজন তার অতিরিক্ত ক্রয় না করার জন্য। সবাই সীমিত কেনাকাটা করলে দাম বাড়ার সুযোগ নেই।
“দাম বাড়ায় সামর্থ্যবানেরা। দিনে এনে দিনে খায় এমন লোকদের কারণে দাম বাড়ে না। সামর্থ্যবানেরা বেশি বেশি কিনে ফ্রিজে রাখে। তাই রমজানের শুরুতে দাম বাড়ে।”
মাহবুবুল আলম বলেন, “আসন্ন রমজান মাসে নিত্যপণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা ও ন্যায্য মুনাফা করতে হবে। পাইকারি থেকে খুচরা পর্যায়ে দাম যেন অস্বাভাবিক না হয় সেজন্য তদারকি ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।”
বাজার মনিটরিং প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “পুলিশ দিয়ে বাজার মনিটরিং করানোর দরকার নেই। বাজার কমিটির নেতারা মনিটরিং করলেই হয়। পণ্যের মূল্য তদারকি না করলে ব্যবসায়ীদের সরকারিভাবে হয়রানির শিকার হতে হবে। কাজেই প্রতিটি বাজার কমিটিকে নিজে থেকেই তদারকি কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।”
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বলেন, “আমরা যদি একজনের দোষ আরেকজনের উপরে চাপিয়ে দেই তাহলে তো হবে না। আমরা ঠিকভাবে এলসি পাচ্ছি না, বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ডলারে সমস্যা হচ্ছে। আর ডিউটি (শুল্ক) বেড়ে গেছে অনেক। এক কোটির পণ্যে ডিউটি যদি ৫০ লাখ টাকা হয়, তাহলে এ ব্যবসা করব কীভাবে?”
তিনি বলেন, “ডলারের যে দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেই দরে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ডলারের বেঁধে দেওয়া দর ১১০ টাকা। এলসি খুলতে ১২৫ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো ‘ইচ্ছেমতো’ ডলারের দাম নিচ্ছে। সে জন্য পণ্য আমদানিতে খরচ বেড়েছে।”
সিরাজুল ইসলাম বলেন, “কিছু কিছু খেজুর কিনে এনেছি ১২০ টাকায়, আর ডিউটি দিতে হচ্ছে ২১০ টাকা। আমি যদি দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ ডিউটি দেই, তাহলে কেনা দামের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই তো দাম বেড়ে যাবে। এবার খেজুরের দাম গতবারের তুলনায় অনেক বেড়েছে শুধু এই ডিউটি বাড়ার কারণে।”
বাংলাদেশ কাঁচামালের আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি ইমরান মাস্টার বলেন, “রমজানে বেগুনের চাহিদা ১০০ গুণ বেড়ে যায়। নৈতিকতা না থাকলে সেমিনার করে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। কাঁচামাল পচনশীল হওয়ায় তা মজুত করা যায় না। সরবরাহ ঠিক রাখতে রোজার তিন-চার মাস আগে প্রণোদনা দিয়ে সরকারিভাবে চাষাবাদের ব্যবস্থা করলে সংকট থাকবে না।”
কাপ্তান বাজার আড়ত মালিক সমিতির সহসভাপতি আব্দুল মান্নান খান বলেন, “বাজারে পণ্য এলে কিছু লোক দাম নির্ধারণ করে দেয়। সেই দামেই বেচাকেনা হয়। দোকানদাররাও মূল্য তালিকা ঝুলায় না। বাজারে সিন্ডিকেট আছে, এটা স্পষ্ট। কৃষক কখনই দায়ী নয়। সিন্ডিকেট ধরার ব্যবস্থা করতে হবে।”
এস আলম গ্রুপের জেষ্ঠ্য মহাব্যবস্থাপক সালাহ উদ্দিন বলন, রমজানে পণ্যের মজুত পর্যাপ্ত আছে। তবে এলসির ক্ষেত্রে ডলারের দর কারও কাছ থেকে ১২০, কারও থেকে ১২৪, আবার কারও থেকে ১২৫ টাকা নেওয়া হয়। এ বিষয়ে তদারকি দরকার।
সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, গ্যাসের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে রোজায় পণ্যের সংকট থাকবে না।
দেশবন্ধু গ্রুপের প্রতিনিধি সারোয়ার জাহান বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চিনিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উল্লেখ করলেও এনবিআর সেটিকে বিলাসবহুল পণ্যের মতো শুল্ক আরোপ করেছে।
এফবিসিসিআইয়ের সিনিয়র সহসভাপতি আমিন হেলালী, সহসভাপতি খায়রুল হুদা চপল, আনোয়ার সাদাত সরকার, মনির হোসেন, পরিচালক ইসহাকুল হক সুইট প্রমুখ মতবিনিময়ে বক্তব্য রাখেন।
কমেন্ট