বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে না পণ্য

বেঁধে দেওয়া দামে মিলছে না পণ্য

রবিবার রাজধানীর শেওড়াপাড়া, কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজার—এই তিন কাঁচাবাজারের কোনোটিতেই দু-একটি ছাড়া সরকার নির্ধারিত দামে এ সব পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, শনিবার রাজধানীর বাজারগুলোতে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকায়।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের শুক্রবার খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দর ৬৫ টাকা ৪০ পয়সা বেঁধে দিয়েছে।

টিসিবির তথ্যই বলছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে না। তার চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। শুধু পেঁয়াজ নয়, বাজারের আগুন নেভাতে শুক্রবার সরকার মাছ,মাংস, ডিম, ডাল, সবজিসহ ২৯ পণ্যের যে দাম বেঁধে দিয়েছে, দু-একটি ছাড়া সব পণ্যই বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

রবিবার রাজধানীর শেওড়াপাড়া, কারওয়ান বাজার ও হাতিরপুল বাজার—এই তিন কাঁচাবাজারের কোনোটিতেই দু-একটি ছাড়া সরকার নির্ধারিত দামে এ সব পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

প্রতিবারের মতো এবারও রমজান মাসকে উপলক্ষ্য করে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়ে অতিরিক্ত মুনাফা করছেন ব্যবসায়ীরা। নিত্যপণ্যের চড়া দাম কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সরবরাহ কম, ভ্যাট বেশি, ডলার সংকট—নানা অজুহারে পণ্যের দাম বাড়িয়েই চলছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা।

বাজারে অভিযান, শুল্ক হ্রাস, ব্যবসায়ীদের ভয়-ভীতিসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না; বেড়েই চলেছে দাম।

এমন পরিস্থিতিতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে ডাল, মাছ, মাংস, ডিম, সবজি ও মুরগি। শুক্রবার কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে এসব দাম ঠিক করে দেওয়া হয়।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মাসুদ করিমের সই করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, “কৃষি বিপণন আইন-২০১৮ এর ৪(ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক কতিপয় নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নিম্নোক্ত দামে কৃষিপণ্য ক্রয়–বিক্রয়ের অনুরোধ করা হলো।”

প্রজ্ঞাপনে একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে। যেখানে এসব পণ্যের নাম, উৎপাদন খরচ, উৎপাদক পর্যায়ের যৌক্তিক দাম এবং পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের যৌক্তিক দাম উল্লেখ করা হয়েছে।

রবিবার শেওড়াপাড়া ও কারওয়ান বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ পণ্য নির্ধারিত দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি ব্রয়লার মুরগি ভোক্তা পর্যায়ে ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা ও সোনালি মুরগির দাম ২৬২ টাকা বেঁধে দিলেও ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ২১০ থেকে ২২০ টাকায়। সোনালি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৭৫ থেকে ২৮০ টাকায়।

টিসিবির বাজারদরেও দেখা যায়, রবিবার ঢাকার বিভিন্ন বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার ২১০ থেকে ২২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে কেনো মুরগি বিক্রি করছেন না—এ প্রশ্নের উত্তরে শেওড়াপাড়া বাজারের মুরগি বিক্রেতা মোল্লা হাফেজ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “কে কতো দাম বেঁধে দিলো সেটা দিয়ে আমরা কি করবো। আমরা যে দামে কিনে আনি, তার চেয়ে সামান্য লাভে বিক্রি করি।”

প্রতিকেজি গরুর মাংস ৬৬৪ টাকা ৩৯ পয়সায় বিক্রি করতে বলেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। কিন্তু কারওয়ান বাজারে ৭৬০ থেকে ৭৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে গরুর মাংস। তবে, রাজধানীর শাজাহানপুরে খলিল গোস্ত বিতানে প্রতি কেজি গরুর মাংস ৫৯৫ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

বেশ কিছুদিন ধরেই বাজারের চেয়ে অনেক কম দামে গরুর মাংস বিক্রি করে সারা দেশে বেশ আলোচিত খলিলুর রহমান। এর আগেও ৫৯৫ টাকা দরে মাংস বিক্রি করেছিলেন তিনি। মাঝে গরুর দাম বেড়ে যাওয়ায় ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করতেন। প্রথম রোজা থেকে আবার ৫৯৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।

এআরএইচ ডট নিউজকে খলিলুর রহমান বলেন, “পুরো রমজান মাসজুড়ে ৫৯৫ টাকা দরে মাংস বিক্রি করবো আমি। সরকার ৬৬৪ টাকা বেঁধে দিলেও আমি ৫৯৫ টাকা দরেই বিক্রি করবো। এই দরে বিক্রি করেও আমার লাভ থাকে।”

অন্যান্য পণ্যের মধ্যে মুগডাল ১৬৫ টাকা ৪১ পয়সা কেজি দরে বিক্রির কথা থাকলেও রবিবার এই পণ্যটি বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা দরে। খুচরা বাজারে ছোলার দাম ৯৮ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হলেও তা বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে।

দুইটি মাছের দাম বেঁধে দিয়েছে সরকার। চাষের পাঙাশ ১৮০ টাকা ও কাতলা ৩৫৩ টাকা দাম নির্ধারণ করে দেয়। তবে আগে থেকেই পাঙ্গাশ ১৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। কাতল মাছও আগে থেকে সাড়ে ৩৫০ দরে বিক্রি হচ্ছিল।

ডিমের দামের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। শেওড়াপাড়া বাজারে রবিবার প্রতি ডজন ডিম ১২০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। প্রতিটির দাম পড়ে ১০ টাকা; হালি ৪০ টাকা। অথচ কৃষি বিপনণ অধিদপ্তর শুক্রবার প্রতি ডিমের দাম ১০ টাকা ৪৯ পয়সা বেঁধে দিয়েছে।

শেওড়াপাড়া বাজারের ডিক্রম বিক্রেতা হালিম বলেন, “গত দুই-তিন দিন ধরে ডিমের দাম কমছে। তিন-চার দিন আগে প্রতি ডজন ডিম ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি করতাম। কাল থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি করছি।”

রবিবার শেওড়াপাড়া বাজারে প্রতি কেজি সাদা বেগুন ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। লম্বা কালেঅ বেগুন বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়। সরকার ৪৯ টাকা ৭৫ পয়সা দরে বিক্রি করতে বলেছে।

ফুলকপি বিক্রি হয়েছে প্রতিটি ৪০ টাকায়। বেঁধে দেওয়া দর ২৯ টাকা ৬০ পয়সা। সিম বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে; বেঁধে দেওয়া দর ৪৮ টাকা।

আলুর দাম বেঁধে দেওয়া হয়েছে ২৮ টাকা ৫৫ পয়সা; বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। নিম্নমানের আলু অবশ্য ২৫ টাকায় বিক্রি হতেও দেখা গেছে।

টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়; বেঁধে দেওয়া দর হচ্ছে ৪০ টাকা ২০ পয়সা।

কাঁচা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে; বেঁধে দেওয়া দর ৬০ টাকা ২০ পয়সা।

২৯ পণ্যের মধ্যে অন্য পণ্যও বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।

রোজা সামনে রেখে গত সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইফতারির অন্যতম উপকরণ খেজুরের দুটি ধরনের দাম নির্ধারণ করে দেয়। বাজারে খেজুরের দাম চড়া—বেশ কিছুদিন ধরে এই অভিযোগ ওঠার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ পদক্ষেপ নিলেও বাজারে ওই দামে খেজুর বিক্রি হচ্ছে না।

অন্যদিকে বেশ কিছুদিন ধরে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বেঁধে দিয়ে আসছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বেঁধে দেওয়া দামে এই দুটি পণ্য কখনই বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায় না।

মাঝে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দাম বেঁধে দেওয়া হলেও সেই দামে পণ্য মেলেনি বাজারে।

ভোক্তাদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “শুধু দাম বেঁধে দিলে হবে না। সেই দামে বাজারে পণ্য বিক্রি হচ্ছে কি না, ভোক্তারা কিনতে পারছে কি না—তা নিশ্চিত করতে হবে।”

তিনি বলেন, “সরকার চেষ্টা করছে, অভিযান চলছে। তারপরও কিন্তু বাজারে পণ্যের দাম কমছে না; উল্টো বাড়ছে। এর মানে হচ্ছে, সরকার ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। অথবা সরকারকে পাত্তা দিচ্ছে না সিন্ডিকেট। যে করেই হোক সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। এটাই এখন সরকারের প্রধান কাজ হওয়া উচিৎ বলে আমি মনে করি।”

মাছ মাংসসহ ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দিল সরকার পরবর্তী

মাছ মাংসসহ ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দিল সরকার

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর