বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি সম্ভব না: দোকান মালিক সমিতি
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির নেতারা সরকারের পক্ষ থেকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মাছ, মাংস, ডিম, ডালসহ ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়াকে ‘কল্পনাপ্রসূত’ আখ্যা দিয়েছেন।
বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি।
মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির নেতারা সরকারের পক্ষ থেকে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে মাছ, মাংস, ডিম, ডালসহ ২৯ পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়াকে ‘কল্পনাপ্রসূত’ আখ্যা দিয়েছেন। তারা বলছেন, বেঁধে দেওয়া দামে তারাই পণ্য পাচ্ছেন না। কিনতে গেলে পণ্যের সংকট দেখা যাচ্ছে। পাইকার পণ্য মজুত করছে, দিচ্ছে না। তাই বেঁধে দেওয়া দামে পণ্য বিক্রি সম্ভব না।
রাজধানীর মগবাজারে দোকান মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন, মহাসচিব জহিরুল হক ভূইয়াসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী সংবাদ সম্মেলনে তাদের অবস্থান তুলে ধরেন।
গত ১৫ মার্চ (শুক্রবার) কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে, সবজি, পেঁয়াজ, ডাল, ডিম, মাছ, মাংসসহ ২৯টি পণ্যের দাম নির্ধারণের সিদ্ধান্তের কথা জানো হয়।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিমের সই করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, “কৃষি বিপণন আইন-২০১৮ এর ৪(ঝ) ধারার ক্ষমতাবলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক কতিপয় নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হলো। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নিম্নোক্ত দামে কৃষিপণ্য ক্রয়–বিক্রয়ের অনুরোধ করা হলো।”
প্রজ্ঞাপনে একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়। যেখানে এসব পণ্যের নাম, উৎপাদন খরচ, উৎপাদক পর্যায়ের যৌক্তিক দাম এবং পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের যৌক্তিক দাম উল্লেখ করা হয়েছে।
তবে এরপরও বাজারে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে পণ্যগুলো কিনতে পারেননি ক্রেতারা।
মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, “মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া যায় না। এখন ২৯ পণ্যের দর নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা এ দামে এসব পণ্যগুলো কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কর্তৃক বিক্রির অনুরোধ জানায়।
“একইসঙ্গে পণ্যগুলোর বিক্রিত লাভ দিয়ে কর্মকর্তারা বেতন নেবেন। সরকারি অর্থে কোনও বেতন নেবেন না। তাহলে মূল চিত্র উন্মচিত হবে যে, আমরা যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, আমাদের আসলে কত টাকা লাভ হয়।”
“হয় তাদের বেঁধে দেওয়া দামে কৃষি বিপণনকে বিক্রি করতে হবে, না হলে এ প্রজ্ঞাপন স্থগিত করতে হবে। আমরা এ দামে বিক্রি করতে পারব না। দাম বেঁধে দেওয়াটা অযৌক্তিক-অবাস্তব ও অর্থহীন।”
ভগ্নাংশে পণ্যমূল্য নির্ধারণের সমালোচনা করে তিনি বলেন, “কেউ যদি আমার কাছ থেকে ১ কেজি বেগুন কেনে, তাকে আমি ১ পয়সা ফেরত দেব, কীভাবে? ফেরত না দিলে আমার বিরুদ্ধে মামলা হবে। আমার সব মিলিয়ে পুঁজি হবে ১০ হাজার টাকা, জরিমানা হবে ৫০ হাজার টাকা।
“যে কয়েনটি বাংলাদেশে নাই, সেই কয়েনের ভিত্তিতে আমাকে ব্যবসা করতে হবে। এর চেয়ে দুঃখজনক, লজ্জাজনক আর কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না।”
এ সময় তিনি ২৯টি পণ্যের মধ্যে কয়েকটি পণ্যের নির্ধারিত দাম তুলে ধরে তা যৌক্তিক হয়েছে কি না প্রশ্ন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে দোকান মালিক সমিতি সাতটি দাবি পেশ করে।
মাঠ পর্যায়ে জরিপ না করার অভিযোগ
পণ্যের দাম বেঁধে দেওয়াকে কেন অযৌক্তিক বলছেন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, “দেখুন যদি জেনে থাকেন তাহলে দেখবেন যে তারা লিখেছে বেগুনের উৎপাদন খরচ ১৮.৫৮ টাকা। এর প্রেক্ষিতে উৎপাদক পর্যায়ের মূল্য হবে ২৯.৬৮ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে হবে ৪২.৮২ টাকা এবং আমরা যারা খুচরা ব্যবসায়ী আছি- আমরা বিক্রি করতে পারব ৫৪.৯৯ টাকায়।
“আমি বলব যারা রুমে বসে এই প্রজ্ঞাপনটি বানিয়েছে তারা মাঠের নূন্যতম জ্ঞান রাখেন না। মাঠ পর্যায়ে সার্ভে ছাড়াযই তারা তাদের মতো করে দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে না।”
শুধু খুচরা বাজারেই কেন হানা
হেলাল উদ্দিন বলেন, “এই যে পাইকারি মূল্য তারা নির্ধারণ করলেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বাস্তবতাটা আসলে কী? বাস্তবতা হলো, পাইকারি ব্যবসায়ীরা এটি মানেন না। তারা পণ্য মজুদ করে রাখে। আমরা কিছু বললে বলেন, মাল নিলে নেন, না নিলে নাই।
“সেখানে মনিটরিং না করে আমাদের উপর একতরফা জুলুম করা হয়। অভিযান, মামলায় আমরা ফেঁসে যাই।”
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কারওয়ান কাঁচাবাজার আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুর রহমান।
তিনি বলেন, “ম্যাজিস্ট্রেট এসে বলেন, ভাউচার কই? ভাউচার নাই তো জরিমানা। এটা যৌক্তিক। কিন্তু, মুকাম থেকে যখন আমরা মাল কিনি, তারা অধিক দামে আমাদের কাছে মাল ছাড়ে, ভাউচার চাইলে ভাউচার দেয় না। বলে, ব্যবসা করলে এভাবেই করবা, মাল নিবা, নয় মাল দিব না।”
এক সাংবাদিক বলেন, বয়লার মুরগির কেজি ১৬২ টাকা ৬৯ পয়সায় পাইকারি পর্যায়ের মূল্য নির্ধারণ করা হলে আপনাদের নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সা। তাহলে আপনাদের সমস্যটা কোথায়? এই টাকায় বিক্রি করলে তো লাভ থাকার কথা।
এই প্রশ্নের উত্তরে সাইফুর রহমান বলেন, “এই তো কাগজের কথা। বাস্তব চিত্র ভিন্ন। কাল রাতেই জানলাম বয়লার মুরগির সংকট। যাও বা আমরা পাচ্ছি, তা নির্ধারিত মূল্যের বেশি দামে। তাহলে ১৭৫ টাকা ৩০ পয়সায় আমরা কীভাবে বিক্রি করব।
“তারপরও দিনের শেষে অভিযান চালানো হয়, আমাদের বাজারে। জরিমানা করা হয় আমাদের” যোগ করেন তিনি।
পাইকারি মূল্য যেটি নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি যদি ঠিক থাকে তবে কি তারা নির্ধারণ করে দেওয়া খুচরা মূল্যেই বিক্রি করবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ কাঁচাবাজার আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান মাস্টার বলেন, “অবশ্যই করব। পাইকারি বাজারটা মনিটরিংয়ের আওতায় আনেন, তাদের কাছ থেকে আমরা সঠিক দামে কিনি, নিজেরাও সঠিক দামে বেচি।”
দোকান মালিক সমিতির সাত দাবি
>> ২৯ পণ্যের মূল্যনির্ধারণ অবিবেচনা, অসার, অর্থহীন ও কল্পনাপ্রসূত। তাই এখনই প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত করতে হাবে। অন্যথায় ব্যবসা বন্ধ করা ছাড়া আমাদের উপায় থাকবে না।
>> বিভিন্ন পণ্যের আমদানি ও উৎপাদনের সঠিক পরিসংখ্যান নিশ্চিত করতে হবে।
>> টিসিবির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রাথমিকভাবে পণ্য আমদানি করে বিপণনের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে বোঝা যাবে ব্যক্তি খাতের সঙ্গে সরকারি খাতের পার্থক্য কত।
>> বাজার ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য একই মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।
>> বাজারের চাহিদা অনুযায়ী পর্যাপ্ত সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
>> ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংস্থার চাপমুক্ত অবস্থায় ব্যবসা করার সুযোগ দিতে হবে।
এবং
>> নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যেপণ্যের উপর আরোপিত সব ট্যাক্স-ভ্যাট কমিয়ে সহনশীল পর্যায়ে আনতে হবে।
কমেন্ট