মজুত কমছে, জুন পর্যন্ত চড়াই থাকবে চালের বাজার

মজুত কমছে, জুন পর্যন্ত চড়াই থাকবে চালের বাজার

সরকারি হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। মাঝারি মানের (পাইজাম-লতা) চালের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সরু (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) চালের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ।

সরকারি গুদামগুলোতে খাদ্যের মজুত বেশ কমে এসেছে। বুধবার মোট মজুতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ১২ হাজার ৫৮৮ মেট্রিক টন। এই মজুত দুই বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। ২০২২ সালের মে মাসে খাবারের মজুতের পরিমাণ ছিল ১২ লাখ ৫২ হাজার টন।

সরকারি গুদামে মজুত কমার খবরে চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে ব্যবসায়ীরা। সরকারি হিসাবেই এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম বেড়েছে ২ শতাংশ। মাঝারি মানের (পাইজাম-লতা) চালের দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সরু (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) চালের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ।

চলতি এপ্রিল মাসের শেষে অথবা মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশে বোরো ধান উঠতে শুরু করবে। ভরা মৌসুম শুরু হবে আসলে জুন থেকে। ফলে তার আগে বাজারে চালের দাম কমার কোনও ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে না।

সরকারি-বেসরকারি কোনও পর্যায়েই চাল আমদানি না হওয়ায় এবং ৩০ টাকা কেজি দরে এক কোটি পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে চাল বিক্রি এবং ১৫ টাকা কেজি দরে ওপেন মার্কেট সেল (ওএমএস) ও ভিজিএফ-ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে চাল বিতরণ অব্যাহত থাকায় খাদ্যের মজুত কমছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ও কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান।

তবে এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ দেখছেন না তারা; বলেছেন, চলতি এপ্রিল মাসের শেষেই বোরো ধান ওঠা শুরু হবে; ফলন বেশ ভালো হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে। তখন মজুত ফের বাড়বে; চালের দামও কমবে।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিদিনের খুচরা বাজার দর অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ঢাকার বাজারগুলোতে প্রতি কেজি মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৫৮ টাকায়। আর সরু চাল (নাজিরশাইল ও মিনিকেট) বিক্রি হচ্ছে ৬৫ থেকে ৭৬ টাকায়।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ও শেওড়াপাড়া বাজারে অবশ্য এর চেয়ে ২/৩ টাকা বেশি দামে চাল বিক্রি হতে দেখা গেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদনে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দেশের সরকারি গুদামগুলোতে সব মিলিয়ে ১২ লাখ ১২ হাজার ৫৮৮ মেট্রিক টন খাদ্য মজুত ছিল। এর মধ্যে চাল ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮৩ টন, গম ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৮২৭ টন ও ধান ২৬৮ টন।

অতীতের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে খাদ্য মজুত ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে ২০ লাখ ১০ হাজার টনে উঠেছিল। কিন্তু এর পর থেকে কমতে কমতে সেই মজুত ওই বছরের মে মাস শেষে ১২ লাখ ৫২ হাজার টনে নেমে আসে।

এরই মধ্যে এপ্রিল থেকে দেশে বোরো ধান ও চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করে সরকার। আমদানিও বাড়িয়ে দেয়। এর ফলে আবার বাড়তে থাকে খাদ্যের মজুত।

আমন সংগ্রহ অভিযান এবং চাল আমদানি বাড়ায় গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরকারি মজুত ১৯ লাখ টনে গিয়ে দাঁড়ায়। এর পর বোরোর বাম্পার ফলনে আমদানি ছাড়াই গত বছরের আগস্টে অতীতের সব কেকর্ড ছাড়িয়ে মজুত সাড়ে ২০ লাখ টনে গিয়ে পৌঁছে।

মজুত ‘যথেষ্ট’

খাদ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতি বছরই আমন ও বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শেষ হওয়ার পর নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে সরকারের গুদামে খাদ্যের মজুত বাড়তে থাকে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সন্তোষজনক মজুত থাকে।

এরপর সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কর্মসূচির অধীনে চাল-আটা বিতরণ ও বিক্রির কারণে এই মজুত কমতে থাকে। মজুত বেশি কমে গেলে সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে মজুত গড়ে তোলে। গত কয়েক মৌসুম বোরো ও আমন ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় খাদ্য নিয়ে চিন্তা করতে হয়নি সরকারকে।

বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আপৎকালীন সংকট মোকাবেলার জন্য সরকারের মজুত ১২ থেকে ১৩ লাখ টন থাকলেই যথেষ্ট বলে মনে করেন খাদ্য কর্মকর্তারা।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম খান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এ মুহূর্তে ৬/৭ লাখ টন মজুত থাকলেই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি। কেননা, কয়েক দিন পরই বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু করবে সরকার। তখন মজুত ফের বেড়ে ২০ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে।”

তবে গত কয়েক বছর স্বস্তিদায়ক মজুত থাকলেও বাজারে চালের দাম কমেনি; উল্টো চলেছে। কে

অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজারে চালের দাম কমছে না- খোদ সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু চালের দাম লাগামের মধ্যে আসেনি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের মানুষের দৈনিক গড়ে চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ গ্রাম। যদি দেশের ১৭ কোটি মানুষের ১৫ কোটিও ভাত খায়, তাহলে প্রতিদিন চাল লাগে প্রায় ৫০ হাজার টন।

আমদানি হয়নি সাড়ে মাস

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সাড়ে নয় মাসে (২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৪ সালের ১৫ এপ্রিল) সরকারি-বেসরকারি কোনও পর্যায়েই চাল আমদানি হয়নি। তবে ৪৫ লাখ ৯২ হাজার ৪৮০ টন গম আমদানি হয়েছে।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৪৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৬০ টন খাদ্য আমদানি হয়েছিল। এর মধ্যে ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৫৬০ টন চাল ও ৩৮ লাখ ৭৫ হাজার ১০০ গম আমদানি হয়।

এদিকে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে বেসরকারিভাবে আরও ১ লাখ ২৪ হাজার টন সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির জন্য ৫০টি প্রতিষ্ঠান অনুমতি দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ১ লাখ ২৪ হাজার টন চালের মধ্যে সিদ্ধ চাল ৯১ হাজার টন এবং আতপ চাল ৩৩ হাজার টন।

এই চাল আমদানির ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। শর্তগুলো হচ্ছে- বরাদ্দ পাওয়া আমদানিকারকদের আগামী ১৫ মে’র মধ্যে পুরো চাল দেশে বাজারজাত করতে হবে। আমদানি করা চালের পরিমাণ, গুদামজাত ও বাজারজাত করার তথ্য সংশ্লিষ্ট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রককে জানাতে হবে।

বরাদ্দের অতিরিক্ত আইপি (ইমপোর্ট পারমিট) বা অনুমতি ইস্যু বা জারি করা যাবে না। আমদানি করা চাল স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠানের নামে পুনরায় প্যাকেটজাত করা যাবে না। চাল বিক্রি করতে হবে আমদানি করা বস্তায়।

এর আগে গত ২১ মার্চ ৮৩ হাজার টন সিদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির জন্য ৩০টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমতি দিয়েছিল সরকার।

তবে ঢাকা স্কুল অব ইকনোমিকসের পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এখন চাল আমদানির কোনও প্রয়োজন নেই। এই তো আর ১৫/২০ দিন পরেই দেশে বোরো ধান ওঠা শুরু করবে।

“এবারও বোরোর বাম্পার ফলন হবে বলে বিভিন্ন জেলা থেকে খবর পাচ্ছি। আমি নিজেও কয়েকটি জেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি। আকস্মিক বন্যা বা বড় ধরনের কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এবার ২ কোটি ২০ লাখ টন বোরো ধান উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই অবস্থায় চাল আমদানির কোনো দরকার নেই।”

সরকার যদি আপৎকালীন সংকটের কথা বিবেচনা করে কিছু চাল আমদানি করতে চয়, সেটা সরকারি উদ্যোগেই করার পরামর্শ দেন তিনি।

“বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দিয়ে চাল আমদানি করলে কোনও লাভ হবে না। কেননা, অতীতে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির সুযোগ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। তারা শুধু শুল্ক ছাড়সহ নানা সুযোগ-সুবিধাই নিয়েছে।”

গত কয়েক বছরে চালের সরবরাহের কোনও সমস্যা ছিল না দাবি করে বাজারে অস্থিরতার জন্য অসাধু চক্রকে দায়ী করেন জাহাঙ্গীর আলম।

তিনি বলেন, “বড় বড় চলকল মালিকদের অসাধুচক্রের সঙ্গে ৫-৬টি বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানও যোগ দিয়ে বাজার অস্থির করে তোলে। ব্রয়লার মুরগি, ডিম, গম ও ভোজ্য তেলের পর এবার চালের বাজারেও থাবা দিয়েছে করপোরেটরা। এভাবে চালের বাজারও করপোরেটদের হাতে চলে গেছে।

“নানা চেষ্টা করেও সরকার চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বাজারে চালের দাম বাড়ার কোনও কারণ ছিল না। সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

একই কথা বলেছেন বাংলাদেশ অটো রাইস মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ বি এম খোরশেদ আলম খান।

তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বাজারে চালের দাম যেটা বেড়েছে, সেটা কিন্তু চালের ঘাটতি বা সংকটের কারণে নয়; কতিপয় বড় বড় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে চালের দাম এমনিতেই কমে আসবে; আমদানির প্রয়োজন হবে না।”

বোরো ধান উঠলে চালের দাম কমে আসবে- এই আশা দেখিয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার বলেন, এবারও বোরোর বাম্পার ফলন হবে।

চালের বাজার সহনীয় রাখতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “এখন থেকে বস্তার গায়ে মিলগেটের দাম, ধানের জাত ও উৎপাদন তারিখ উল্লেখ করতে হবে। এতে মিলগেটের দর জানতে পারবেন ক্রেতারা। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর আইন প্রতিরোধ) আইন ২০২৩ এর বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। খুব শিগগিরই এটি বাস্তবায়ন হবে।

“আইন বাস্তবায়ন হলে ছাঁটাই করে চালের পুষ্টিকর অংশ বাদ দেওয়া বন্ধ হবে। বস্তার গায়ে মিলগেটের দাম, ধানের জাত ও উৎপাদন তারিখ উল্লেখ থাকবে। এতে চালে বাড়তি মুনাফা করার প্রবণতা কমে আসবে।”

সোনার দাম নিয়ে বাজুসের ‘অদ্ভুদ’ খেলা পূর্ববর্তী

সোনার দাম নিয়ে বাজুসের ‘অদ্ভুদ’ খেলা

সোনার ভরি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ছুঁই ছুঁই পরবর্তী

সোনার ভরি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা ছুঁই ছুঁই

কমেন্ট