বিবিএসের হিসাবেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০% ছাড়াল
মার্চে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ; যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) হিসাবে বর্তমানে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এতদিন এই হার এক অঙ্কের (সিঙ্গেল ডিজিট) নিচে দেখিয়ে এলেও এখন তাদের হিসাবও দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) ঘরে গেল।
সরকারি পরিসংখ্যান সংস্থা বিবিএস সোমবার মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দশম মাস এপ্রিলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক বা মাসওয়ারি) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এই সময়ে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ হলেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ।
চার মাস পর খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে উঠল।
বিবিএসের হিসাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সামান্য কমলেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
আগের মাস মার্চে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ; যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ, খাদ্যবহির্ভূত খাতে ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
এপ্রিলে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২৩ সালের এপ্রিলে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিল, এই বছরের এপ্রিলে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৭৪ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।
১০ দশমিক ২২ শতাংশ খাদ্য মূল্যস্ফীতির অর্থ হলো ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে যে খাদ্যপণ্য ১০০ টাকায় পাওয়া যেত, তার জন্য এখন ১১০ টাকা ২২ পয়সা খরচ করতে হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে সাবিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে ওঠেছিল। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ।
পরের মাস সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হার ছিল ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ।
অক্টোবরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ; খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ।
পরের মাস নভেম্বরে ৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতির মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমে আসে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে নেমে আসে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশে। খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৮ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে।
এর পর গত কয়েক মাস খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি বাড়লেও খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের (দু্ই অঙ্কের) নিচেই ছিল। এপ্রিলে এসে তা ফের দুই অঙ্কের ঘরে ১০ দশমিক ২২ শতাংশে উঠেছে।
গত বৃহস্পতিবার খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশ বলে তথ্য দিয়েছিল বিআইডিএস। প্রতিষ্ঠানের একটি জরিপের তথ্য উল্লেখ করে বিআইডিএস মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বলেছিলেন, “সম্প্রতি বিআইডিএসের পক্ষ থেকে দেশের সব জেলা থেকে তথ্য নিয়েছি। এরপর একটি পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করা হয়েছে। তাতে দেখা গেছে, খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৫ শতাংশ।”
সাধারণত মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে বিবিএস। তবে বিআইডিএস পৃথক পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতি হিসাব করেছে।
বিনায়ক সেন বলেছিলেন, খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে মাছের দাম। গত এক বছরে মাছের দাম ২০ শতাংশের ওপর বেড়েছে।
তিনি আরও বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ অসুবিধায় রয়েছে।
ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি বেশ দ্রুত গতিতে কমলেও বাংলাদেশে কমার তেমন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমন কি অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কাও মূল্যস্ফীতি ৪ শতাংশে নামিয়ে এনেছে।
মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে দুই বছর ধরে। তার আওতায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমানোসহ নানা পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তারপরও মূল্যস্ফীতি কমেনি।
১২ মাসের গড় হিসাবে (২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছিল সরকার। কিন্তু অর্থবছর শেষে দেখা যায়, বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে ৩ দশমিক ৪২ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির হার ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ববাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ায় মূল্যস্ফীতি বাড়তে বাড়তে ১২ শতাংশ ছাড়িয়েছিল।
২০০৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ সরকার যখন দায়িত্ব নেয়, তখনও মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। পরে অবশ্য তা কমে আসে। দীর্ঘদিন তা ৫ থেকে ৬ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতি চড়তে থাকে।
চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরেছে। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই দেশের সব অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থাগুলো বলে আসছিল, সরকারের আশা পূরণ হওয়ার নয়।
এখনও শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি
এপ্রিলে পল্লী এলাকায় বা গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে উঠেছে। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ।
আগের মাস মার্চে গ্রামে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৬৮ শতাংশ। যার মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ।
এপ্রিলে শহর এলাকায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ। এরমধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ১৯ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক শূন্য এক শতাংশ।
মার্চে শহরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ; খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয় ৯ দশমিক ৭১ শতাংশ।
২০১০-১১ অর্থবছরে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর পর তা দুই অঙ্কের (ডাবল ডিজিট) নিচে নেমে আসে। ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই সূচক ৯ শতাংশের ওপরে ওঠেনি।
মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম
আয় বেশি বাড়লে জিনিসপত্রের দাম বাড়লেও তা কিনতে তেমন সমস্যা হয় না। কিন্তু দেশে দেড় বছর ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে মজুরি বৃদ্ধির হার কম।
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, এপ্রিলে জাতীয় মজুরি হার ছিল ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ, এর মানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি।
গ্রাম-শহরনির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে থাকে বিবিএস।
মজুরিনির্ভর বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি পড়ে। বিবিএস বলছে, দেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। দেশে এরকম কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা ছয় কোটি মতো।
কমেন্ট