চামড়ার দাম এবার কিছুটা বেশি
পোস্তায় ১০ টাকা দরে খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে। যেখানে গরুর চামড়ার সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ৯০০ টাকা।
কোরবানির গরুর চামড়ার কদর আর আগের মতো নেই। গরুর চামড়ার দাম কমতে কমতে ২০১৯ সালে এসে ধস নেমেছিল। সে বছর ন্যূনতম দাম না পেয়ে কোথাও কোথাও চামড়া নদীতে ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
পরের বছর সরকার তৎপরতা বাড়ালে চামড়ার দামে কিছুটা পরিবর্তন দেখা যায়। তারপর গত তিন বছর দাম কিছুটা বাড়লেও এক দশক আগের দাম ওঠেনি। এক দশক আগে ২০১৩ সালে আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল গরুর কাঁচা চামড়ার দাম।
এবার গত বছরের তুলনায় দাম কিছুটা বেড়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সোমবার ঈদের দিন বিকাল থকেই ঢাকায় চামড়ার প্রধান বাজার পুরান ঢাকার পোস্তায় নিয়ে যেতে শুরু করেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা, যারা বিভিন্ন এলাকা ও মাদ্রাসা থেকে এসব চামড়া সংগ্রহ করেন।
এবার গরুর চামড়ার বাজার কেমন তা জানতে এআরএইচ ডট নিউজ কথা বলেছে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন এবং মৌসুমি ব্যবসায়ী ও কোরবানি যারা দিয়েছেন তাদের সঙ্গে।
তাদের ভাষ্যমতে, এখন পর্যন্ত গরুর চামড়ার দাম ভালোই আছে। সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ৯০০ টাকা। দুই একদিন গেলে পরিস্থিতি আরও ভালো বোঝা যাবে।
ঢাকার বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা প্রতিটি গরুর চামড়া বিক্রি করে ৭০০-৮০০ টাকা করে পেয়েছে। তবে খাসির চামড়া বিক্রি করতে পারেনি অনেকেই। যা আবর্জনা হিসেবে ফেলে দিতে হয়েছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পোস্তায় এদিন ১০ টাকা দরে খাসির চামড়া বিক্রি হয়েছে। যেখানে গরুর চামড়ার সর্বোচ্চ দাম উঠেছে ৯০০ টাকা।
ঢাকার নর্দা এলাকার বাসিন্দা ইসলাম সরকার এবার দুটি গরু কোরবানি দিয়েছেন। তবে গরু জবাইয়ের পর চামড়া নিজে বিক্রি করেননি। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় দান করেছেন।
ওই এলাকার মারকাযুল উলূম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার পরিচালক মুফতী তাহের ছাঈদ হাফিযাল্লাহু এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ঈদের দিন বিকাল ৫টা পর্যন্ত ১৮০টির মতো গরুর চামড়া স্থানীয় লোকজনরা দান করেছেন। আমরা সেগুলো সংগ্রহ করে মাদ্রাসায় এনে রেখেছি।
“এখন পর্যন্ত তিনজন মৌসুমি ব্যবসায়ী এই চামড়া কিনতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। দাম উঠেছে ৭০০-৮০০ টাকা। আমরা আরেকটু বেশি দাম প্রত্যাশা করছি। এ কারণে এখনও চামড়াগুলো বিক্রি করিনি। আর ঘণ্টাখানেক দেখব। তারপর হয়তো ৮০০ টাকায় ছেড়ে দেব।”
তিনি জানান, গত বছর তারা যে চামড়াগুলো পেয়েছিলেন তা বিক্রি করেন ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা দরে।
খাসির চামড়ার কোনও ক্রেতা নেই জানিয়ে মারকাযুল উলূম আল ইসলামিয়া মাদ্রাসার পরিচালক বলেন, “খাসির চামড়া কেউ কিনতে রাজি না। এগুলো আবর্জনার ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।”
দেশে পশুর চামড়ার যে চাহিদা, তার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই পূরণ হয় কোরবানির ঈদে। ফলে এটাই চামড়া সংগ্রহের মূল মৌসুম। এই চামড়া দিয়ে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি থেকে গত কয়েক অর্থবছর দেশ গড়ে আয় করছে ১২০-১২৫ কোটি ডলার।
কোরবানির পশুর যেসব চামড়া মৌসুমী ব্যবসায়ী ও মাদ্রাসা সংগ্রহ করে তারা সেগুলো বিক্রি করেন মূলত পোস্তায়। কাঁচা চামড়া যেন নষ্ট না হয় সেজন্য আড়তে চামড়া পরিষ্কার করে লবণ মাখানো হয়। লবণ মাখানো এই চামড়াই যায় ট্যানারিতে।
এবার এপ্রিলজুড়ে তীব্র দাবদাহের পর মে মাসে বৃষ্টির দেখা মিললেও কোরবানির আগে গরম তেমন কমেনি। এই গরম নিয়েই চিন্তায় ছিলেন কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব টিপু সুলতান জানিয়েছেন, তাপমাত্রা অনুকূলে আছে। চামড়া নষ্ট হওয়ার শঙ্কা নেই।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “বিকাল থেকেই চামড়া আসতে শুরু করেছে। এখন ঢাকার বিভিন্ন আড়তে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা হচ্ছে। এই চামড়াগুলোতে লবণ মাখিয়ে তারপর আমাদের কাছে বিক্রি করা হবে। আমাদের কাছ থেকে ট্যানারি মালিকরা তা কিনে নেবে।”
তিনি বলেন, “তাপমাত্রা নিয়ে আমরা কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। তবে ঢাকায় আজ সারাদিন তাপমাত্রা অনেকটা অনুকূলে ছিল। ফলে চামড়া নষ্ট হওয়ার মতো কোনও শঙ্কা দেখা যায়নি।”
অন্যান্য বারের মতো এবারও কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। ঢাকার ভেতরে গরুর প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। একটি চামড়ার সর্বনিম্ন দাম হবে ১ হাজার ২০০ টাকা। ঢাকার বাইরে এই দাম সর্বনিম্ন ১ হাজার টাকা। গত বছরের তুলনায় প্রতি বর্গফুটের দাম বেড়েছে ৩ থেকে ৫ টাকা।
এবার সারাদেশে খাসি ছাগলের চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম হবে ২০ থেকে ২৫ টাকা। এছাড়া বকরির চামড়ার দাম হবে প্রতি বর্গফুটে ১৮ থেকে ২০ টাকা। গত বছর খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা।
সেই হিসাবে গত বছরের তুলনায় চামড়ার দাম কিছুটা বাড়লেও এক দশক আগের দাম ওঠেনি।
২০১৩ সালে ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ছিল ৮৫-৯০ টাকা। খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৫০-৫৫ টাকা। ওই বছর ঢাকায় ছোট আকারের গরুর চামড়ার দাম ছিল ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা, মাঝারি আকারের গরুর চামড়া ছিল ১ হাজার ৮০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা। আর বড় আকারের গরুর চামড়ার দাম পাওয়া যায় আড়াই হাজার থেকে ২ হাজার ৮০০ টাকা।
এর পর বিভিন্ন কারণে চামড়ার দাম ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। ২০১৯ সালে নামে ধস। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সিলেটের কুশিয়ারা নদীতে তিনশ’র বেশি চামড়া ফেলে দেয় ওই এলাকার কয়েকটি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ।
২০২১ সালে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার সরাইল উপজেলার অনেকেই কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করতে না পেরে মাটিতে পুঁতে ফেলেন। কেউ কেউ নদীতে ভাসিয়ে দেন চামড়া। তবে এবার তেমন আশঙ্কা করছেন না ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা।
গরুর চামড়ার দর আনুষ্ঠানিকভাবে কমতে শুরু করে ২০১৪ সালে। ওই বছর চামড়া ব্যবসায়ীদের তিন সংগঠন চামড়ার দর ২০১৩ সালের তুলনায় কিছুটা কমিয়ে প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৭০-৭৫ টাকা নির্ধারণ করে।
যদিও বাস্তবে আরও বেশি দরে বিক্রি হয়েছিল, সেবার পুরান ঢাকার লালবাগের পোস্তায় লবণবিহীন প্রতি বর্গফুট চামড়া বিক্রি হয় ৯০-১০০ টাকায়। এরপর থেকে চামড়ার দর শুধু কমেছেই।
এবার পরিস্থিতি তুলনামূলক ভালো বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “এখন পর্যন্ত যে তথ্য আমাদের কাছে আছে তাতে চামড়ার দাম ভালোই আছে বলে মনে হচ্ছে। সারা দেশ থেকে চামড়া আসতে শুরু করেছে। দুই একদিন গেলে পরিস্থিতি আরও ভালো করে বোঝা যাবে।”
কমেন্ট