পৌনে ২ লাখ টাকা ছুঁইছুঁই সোনার ভরি
পাঁচ দিনের ব্যবধানে প্রতিভরি ২২ ক্যারেট সোনার দাম ১০ হাজার ৩৬৯ টাকা বেড়েছে।
সোনার দাম বাড়ছেই। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের বাজারেও সোনার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে; রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ছে।
মঙ্গলবার থেকে সবচেয়ে ভালো মানের (২২ ক্যারেট) প্রতিভরি সোনা ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকায় বিক্রি হবে। ভরিতে বেড়েছে ৪ হাজার ৭১২ টাকা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই সোনার দর এত উচ্চতায় উঠেনি।
অন্যান্য মানের সোনার দরও প্রায় একই হারে বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে দেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি (বাজুস)।
একদিন আগে রবিবার (১৯ এপ্রিল) ২২ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিতে ২ হাজার ৬২৪ টাকা বাড়ানো হয়েছিল; ভরি উঠেছিল ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৩ টাকায়।
তার তিন দিন আগে ১৬ এপ্রিল ২২ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিতে ৩ হাজার ৩৩ টাকা বাড়ানো হয়েছিল; ভরি উঠে ১ লাখ ৬৫ হাজার ২০৯ টাকায়।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, পাঁচ দিনের ব্যবধানে প্রতিভরি ২২ ক্যারেট সোনার দাম ১০ হাজার ৩৬৯ টাকা বেড়েছে।
১৩ এপ্রিল অবশ্য এই মানের সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৩৮ টাকা কমানো হয়েছিল; নেমেছিল ১ লাখ ৬২ হাজার ১৭৬ টাকায়। একদিন আগে ১২ এপ্রিল ভরিতে ৪ হাজার ১৮৭ টাকা বাড়ানোয় ভরি ১ লাখ ৬৩ হাজার ২১৪ টাকায় উঠেছিল।
ঈদের আগে কয়েক দফা বাড়ায় ২২ ক্যারেট মানের সোনার ভরি ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৭২ টাকায় ওঠে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের ধাক্কায় বিশ্ব বাজারে সোনার দরপতন হয়। তার সঙ্গে সমন্বয় করে গত ৮ এপ্রিল দেশের বাজারেও সব মানের সোনার দাম কমানো হয়। ওই দিন ২২ ক্যারেট সোনার দর ভরিতে ১ হাজার ২৪৮ টাকা কমানো হয়। ভরি নামে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৬২৪ টাকায়।
১০ এপ্রিল ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন ছাড়া অন্য সব দেশের পাল্টা শুল্ক ৯০ দিন স্থগিতের ঘোষণা দেওয়ার পর বিশ্ববাজারে ফের চড়তে থাকে সোনার দর। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে প্রতি আউন্স (৩১.১০৩৪৭৬৮ গ্রাম) সোনার দর ৩ হাজার ২০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।
এর আগে কখনই আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দর ৩ হাজার ২০০ ডলার ছাড়ায়নি। ১৬ এপ্রিল ৩ হাজার ৩০০ ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
আরও চড়ে সোমবার (২১ এপ্রিল) ৩ হাজার ৪ ০০ ডলারের মাইলফলকও অতিক্রম করেছে।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারেও সোনার দাম বাড়িয়ে চলেছে বাজুস।
ঈদের দুই দিন আগে ২৯ মার্চ ২২ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৭৭৩ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। তার তিন দিন আগে ২৬ মার্চ বাড়ানো হয় ভরিতে ১ হাজার ১৫৫ টাকা।
চড়তে চড়তে গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২২ ক্যারেট মানের সোনার ভরি ১ লাখ ৫৪ হাজার ৫২৫ টাকায় উঠেছিল। পরে অবশ্য কয়েক দফায় কমে ভরি দেড় লাখ টাকার নিচে নেমে এসেছিল।
গত ১৬ মার্চ ২২ ক্যারেট সোনার দাম ভরিতে ২ হাজার ৬১৩ টাকা বাড়ানো হয়েছিল; ভরি ওঠেছিল ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৭৫ টাকায়।
তার আগে তিন দফায় ৬ হাজার ১৮২ টাকা কমানোর পর গত ৪ মার্চ এক দিনেই ২২ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিতে ৩ হাজার ৫৫৮ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বাজুস।
তিন দিনের ব্যবধানে ৮ মার্চ প্রতিভরি সোনার দাম ১ হাজার ৩৮ টাকা কমানো হয়। ভরি নেমেছিল ১ লাখ ৫০ হাজার ৮৬২ টাকায়। ১ মার্চ ২ হাজার ৬২৪ টাকা কমানোয় ভরি দেড় লাখ টাকার নিচে ১ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৩ টাকায় নেমেছিল।
ওই সময় টানা আট দফায় ২২ ক্যারেট সোনার ভরি ১৬ হাজার ২৩৬ টাকা বেড়েছিল। এর পর ছয় দিনের ব্যবধানে তিন দফায় ৬ হাজার ১৮২ টাকা কমে দেড় লাখ টাকার নিচে নেমে এসেছিল।
বাজুসের নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, মঙ্গলবার থেকে দেশের বাজারে হলমার্ক করা এক গ্রাম ২২ ক্যারেট সোনা কিনতে ১৪ হাজার ৭৯৩ টাকা লাগবে। ১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রামে এক ভরি হিসাবে প্রতিভরিতে খরচ হবে ১ লাখ ৭২ হাজার ৫৪৬ টাকা।
২১ ক্যারেটের প্রতিভরি সোনা কিনতে লাগবে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৬৯৬ টাকা। ১৮ ক্যারেটে লাগবে ১ লাখ ৪১ হাজার ১৬৯ টাকা।
আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনা বিক্রি হবে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৮০ টাকায়।
সোমবার পর্যন্ত এক গ্রাম ২২ ক্যারেট সোনা কিনতে ১৪ হাজার ৩৮৯ টাকা লেগেছে। প্রতিভরিতে খরচ হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৮৩৩ টাকা। ২১ ক্যারেটের প্রতিভরি সোনা কিনতে লেগেছে ১ লাখ ৬০ হাজার ২০৫ টাকা। ১৮ ক্যারেটে লেগেছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৩০৯ টাকা।
আর সনাতন পদ্ধতির এক ভরি সোনা বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৯১ টাকা।
হিসাব বলছে, মাত্র এক দিনের ব্যবধানে প্রতিভরি ২২ ক্যারেট সোনার দাম বেড়েছে ৪ হাজার ৭১২ টাকা। ২১ ক্যারেটের দাম বেড়েছে ৪ হাজার ৪৯১ টাকা। ১৮ ক্যারেটের বেড়েছে ৩ হাজার ৮৬০ টাকা।
সনাতন পদ্ধতির প্রতিভরির দাম বেড়েছে ৩ হাজার ২৮৯ টাকা।
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর ২২ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ৫০ টাকা কমানো হয়েছিল। ২৩ ডিসেম্বর কমানো হয় ১ হাজার ২৪৮ টাকা।
১৯ ডিসেম্বর ২ হাজার ৮৮ টাকা বাড়ানো হয়েছিল; ১৫ ডিসেম্বর ১ হাজার ৭৭৩ টাকা কমানো হয়েছিল। ১২ ডিসেম্বর বাড়ানো হয় ১ হাজার ৮৭৮ টাকা।
এভাবে উঠানামার মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছিল ২০২৪ সাল। গত বছরে মূল্যবান এই ধাতুর দর ৩৫ বার বেড়েছিল; কমেছিল ২৭ বার।
২০২৫ সালের শুরুতে সোনার দাম টানা বাড়ছিল। প্রথম বাড়ে ১৫ জানুয়ারি, এরপর টানা আট দফা বাড়ে। এরমধ্যে ২০২৫ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বেড়েছিল তিন বার। আর ফেব্রুয়ারি মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত বাড়ে পাঁচ বার।
এর পর বিশ্ব বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারেও সোনার দর নিম্মমূখী হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২২ ক্যারেটের দাম কমে ভরিতে ১ হাজার ১৫৫ টাকা। ২৭ ফেব্রুয়ারি ভরিতে ২ হাজার ৪০৩ টাকা কমানো হয়।
গত মার্চ মাসে দেশের বাজারে সোনার দাম দুই দফা কমেছে; বেড়েছে পাঁচ বার। আর চলতি এপ্রিল মাসে এ পর্যন্ত পাঁচ দফা বাড়ল; কমেছে দুই বার।
বাজুসের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরে দেশের বাজারে সোনার দাম ১৮ দফা বেড়েছে; কমেছে ৬ বার।
গত বছরের শেষ দিন ৩১ ডিসেম্বর এক ভরি ২২ ক্যারেট সোনার দাম ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার ২ ৮৮ টাকা। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের ৩ মাস ২১ দিনে এই মানের সোনার দর ভরিতে ৩৪ হাজার ২৫৮ টাকা বেড়েছে।
সোমবার রাতে বাজুসের মূল্য নির্ধারণ ও মূল্য পর্যবেক্ষণ স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান মাসুদুর রহমানের সই করা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে বলা হয়, স্থানীয় বাজারে তেজাবি স্বর্ণের (পিওর গোল্ড) মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে সোনার নতুন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার থেকে নতুন দর কার্যকর হবে বলে জানিয়েছে বাজুস।
বিশ্ব বাজারেও ছুটছে
বিশ্ব বাজারেও সোনার দর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আউন্স ৩ হাজার ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে।
গত ২ এপ্রিল ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ঘোষণার আগে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতি আউন্স সোনার দাম ৩ হাজার ৩৭ ডলার থেকে বেড়ে ৩ হাজার ১৬২ ডলারে উঠে গিয়েছিল। পরে সেই সোনার দর ৩ হাজার ডলারে নেমে আসে।
গত কয়েক দিনে তা ফের বেড়ে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। গত ১৬ এপ্রিল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দর বেড়ে ৩ হাজার ৩২০ ডলারে ওঠে; গত কয়েক দিনে তা আরও বেড়ে ৩ হাজার ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে।
সোমবার রাত ৯টায় বিশ্ব বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দাম ছিল ৩ হাজার ৪১২ ডলার ৯৭ সেন্ট। বেড়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
গত ১৯ এপ্রিল রাতে বাজুস যখন দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় তখন বিশ্ব বাজারে প্রতি আউন্স সোনার দর ছিল ৩ হাজার ৩১৫ ডলার ১৩ সেন্ট।
৩ হাজার ৭০০ ডলারে উঠতে পারে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কের জেরে বিশ্ব বাজারে যেভাবে সোনার দাম বাড়ছে, তাতে চলতি বছরের শেষ নাগাদ সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৭০০ ডলারে উঠতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান মার্কস।
এর আগের তাদের পূর্বাভাস ছিল আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৩০০ ডলার। শুধু তা–ই নয়, তারা বলছে, সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৬৫০ ডলার থেকে ৩ হাজার ৯৫০ ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করতে পারে।
মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা ও সোনাভিত্তিক এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) বিনিয়োগ বাড়বে—এই অনুমানের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাক্স।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সংবাদে বলা হয়েছে, এর মধ্যে মন্দা হলে বছরের শেষ নাগাদ সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৮৮০ ডলারে উঠতে পারে। গত শুক্রবার এই নোটে এই পূর্বাভাস দিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাক্স।
গোল্ডম্যান স্যাক্স আরও বলেছে, এ পরিস্থিতিতে নীতিগত অনিশ্চয়তা দূর হলে সোনার ইটিএফে বিনিয়োগ পূর্বাভাস অনুযায়ী হবে। অর্থাৎ নির্ধারিত সুদভিত্তিক ইটিএফেও বিনিয়োগ হবে। সেই বাস্তবতায় সোনার দাম অতটা বাড়বে না বলেই মনে করছে গোল্ডম্যান স্যাক্স। তখন সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩ হাজার ৫৫০ ডলার পর্যন্ত উঠতে পারে বলে গোল্ডম্যানের পূর্বাভাস।
এ ছাড়া চলতি বছর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনার চাহিদা প্রতি মাসে ৮০ মেট্রিক টনে উঠবে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাক্স। আগের বছর যা ছিল ৭০ মেট্রিক টন।
গোল্ড প্রাইস ডট অর্গের তথ্যানুসারে, গত এক মাসে বিশ্ব বাজারে সোনার দাম বেড়েছে আউন্সপ্রতি ২৭৯ ডলার। গত এক বছরে বেড়েছে ৯২৬ ডলার।
সোনার ব্যবহার কেবল গয়নার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনার রিজার্ভ আবার বাড়ছে। মানুষও সোনার বার ও সোনাভিত্তিক এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ডে (ইটিএফ) বিনিয়োগ বাড়ছে।
ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যানুসারে, গত বছর সারা বিশ্বে সোনা বেচাকেনা হয়েছে ৪ হাজার ৯৭৪ টন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সোনা কেনা বাড়ছে। ২০২৪ সালে এ নিয়ে টানা তিন বছর বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সম্মিলিতভাবে এক হাজার টনের বেশি সোনা কিনেছে। গত বছর সবচেয়ে বেশি সোনা কিনেছে পোল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারা কিনেছে ৯০ টন সোনা।
বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশের বাজারেও সোনার দাম বাড়ছে।
কমেন্ট