মে মাসে রপ্তানি আয়ের অর্ধেকই এসেছে নিট পোশাক থেকে

মে মাসে রপ্তানি আয়ের অর্ধেকই এসেছে নিট পোশাক থেকে

মে মাসে নিট পোশাক থেকে ২৩১ কোটি ডলার আয় হয়েছে। ছবি-এআরএইচ ডটকম

মে মাসে রপ্তানি আয়ে যে উল্লম্ফন হয়েছে তাতে বড় অবদান রেখেছে নিট পোশাকে। কম দামি এই পোশাকে ভর করেই রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।

গত মে মাসে এই খাত থেকে ২৩১ কোটি (২.৩১ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেক।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রোববার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, নানা উদ্বেগ-উৎকষ্ঠার মধ্যেও রপ্তানি আয় ফের বাড়ছে। সবশেষ মে মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৮৪ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার (৪.৮৫ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা।

এই অঙ্ক আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেশি। আর গত বছরের মে মাসের চেয়ে বেশি ২৬ দশমিক ৬১ শতাংশ।

তবে মে মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ কম আয় দেশে এসেছে। এই মাসে ৫১২ কোটি (৫.১২ বিলিয়ন) ডলারের লক্ষ্য ধরা ছিল। গত বছরের মে মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩৮৩ কোটি (৩.৮৩ বিলিয়ন) ডলার।

সব মিলিয়ে ৩০ জুন শেষ হওয়া বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিভিন্ন দেশে পণ্য রপ্তানি করে ৫ হাজার ৫২ কোটি ৭২ লাখ ৪০ হাজার (৫০.৫৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। যা গত ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, মে মাসে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক থেকে এসেছে ৪০৫ কোটি (৪.০৫ বিলিয়ন) ডলার। এরমধ্যে নিট পোশাক থেকে এসেছে ২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের মে মাসের চেয়ে বেশি আয় হয়েছে ৩২ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

আর ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ১ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ১৫ শতাংশ।

সামগ্রিকভাবে মে মাসে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এই মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। আয় হয়েছে ৪ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মে মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় লক্ষ্যের চেয়ে ১ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম এসেছে।

বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে (১২ মাস, ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) পোশাক রপ্তানি থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা আছে ৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার । এরমধ্যে ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে আয় হয়েছে ৪২ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার।

গত ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ১১ মাসে আয় হয়েছিল ৩৮ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে জুলাই-মে সময়ে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

আচ্ছা এক ফাঁকে বলে নেওয়া যাক, নিট আর ওভেন শ্রেণিতে কোন কোন পোশাক রয়েছে। সাধারণ কথায় গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি পোশাকই নিট। যেমন টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টস প্রভৃতি। এই পোশাকগুলোর দাম তুলনামূলকভাবে কম।

অন্যদিকে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম প্রভৃতি ওভেন পোশাক হিসেবে পরিচিত; যার দাম বেশি।

নিট পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘গ্যাস-বিদুৎসহ নানা সংকটের মধ্যেও নিট পোশাক থেকে আয় বাড়ায় আমরা খুশি। তবে এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয় না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। সে কারণে তাদের এখন খাদ্যের পেছনে বেশি ব্যয় করছে।”

“যুদ্ধ কবে শেষ হবে? বিশ্ব পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? তার কোনো ঠিক নেই। তাই ওই সব দেশের মানুষ ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। এরই মধ্যে আমাদের দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের তীব্র সংকট দেখঅ দিয়েছে। উৎপাদন কর্মকাণ্ড মারাত্মভাবে ব্যহত হচ্ছে।”

“সে কারণে আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি বাড়ার কোনো কারণ আমি দেখি না,” বলেন হাতেম।

ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-মে সময়ে অর্থাৎ বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসেই রপ্তানি আয় গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ের (১২ মাস, জুলাই-জুন) কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। প্রবৃদ্ধির এই ধারা বজায় থাকলে জুন শেষে পণ্য রপ্তানি আয়ে রেকর্ড গড়তে চলেছে বাংলাদেশ। যদিও এর আগের দুই মাসে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি দুশ্চিন্তা তৈরি করেছিল।

টানা দুই মাস (মার্চ-এপ্রিল) পিছিয়ে থাকার পর মে মাসের রপ্তানিতে আবার উল্লম্ফন হয়েছে। মার্চ মাসে ২ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং এপ্রিলে ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কমে যায় রপ্তানি। গতি ফিরেছে মে মাসে। প্রায় ২৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে এই মাসে।

ইপিবি মে মাসের রপ্তানির যে তথ্য প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, এই মাসে ৪৮৪ কোটি ৯৬ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। রপ্তানির এই পরিমাণ ২০২২ সালের মে মাসের রপ্তানি আয়ের (৩৮৩ কোটি ২ লাখ ডলার) চেয়ে ২৬ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।

মে মাস মিলিয়ে চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে রপ্তানির পরিমাণ মোট দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫২ কোটি ৭২ লাখ ডলার। এই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। তার আগের অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে রপ্তানি হয়েছিল ৪ হাজার ৭১৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পণ্য।

২০২১-২২ অর্থবছরে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে রপ্তানি আয় প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪ হাজার ৩০৪ বিলিয়ন ডলার, কিন্তু আয় হয় ৫ হাজার ২০৮ বিলিয়ন। সেই রেকর্ডে ভর করে চলতি অর্থবছরে ৫৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।

তবু লক্ষ পূরণ হয়নি

বড় প্রবৃদ্ধি হলেও মে মাসের রপ্তানি আয় লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে পারেনি। এ মাসে ৫১২ কোটি ডলার সমমূল্যের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল সরকার। পরিকল্পনার চেয়ে ৫ দশমিক ২৯ শতাংশ পিছিয়ে আছে আয়।

গত নভেম্বর থেকে টানা তিন মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য রপ্তানি করতে পেরেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসে ৫৩৬ কোটি ৫২ লাখ ডলার আয় হয় রপ্তানি থেকে, যা একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।

এরপর জানুয়ারিতে ৫১৩ কোটি ৬২ লাখ ডলার এবং ফেব্রুয়ারিতে ৪৬৩ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। মোট অংক ডিসেম্বরের তুলনায় কমলেও ওই দুই মাসে প্রবৃদ্ধি বজায় ছিল।

কিন্তু মার্চ মাসে তাতে ছেদ পড়ে। আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২.৪৯ শতাংশ কম আয় করে বাংলাদেশ। রপ্তানি হয় ৪৬৪ কোটি ৩৯ লাখ ডলার।

এপ্রিলের ধাক্কা আরও বড় হয়। এই মাসে ৩৯৫ কোটি ৬০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের একই মাসের তুলনায় তা ছিল ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ কম।

অন্যান্য খাত

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি আয় কমেছে। প্রধান খাতগুলোর মধ্যে জুলাই-মে সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে হিমায়িত মাছ রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানি কমেছে ২৮ শতাংশের মতো। ওষুধ রপ্তানি কমেছে ১০ শতাংশ।

পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল থেকে কমেছে ৩০ দশমিক ১৪ শতাংশ।

স্পেশালাইজড টেক্সটাইল থেকে আয় কমেছে ১৪ শতাংশ। বাইসাইকেল কমেছে ১৬ দশমিক ৯০ শতাংশ।

চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে দশমিক ৪২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১৪ শতাংশ।

 

 

 

রপ্তানি আয়ে ফের উল্লম্ফন, মে মাসে বেড়েছে ২৬.৬১ শতাংশ পরবর্তী

রপ্তানি আয়ে ফের উল্লম্ফন, মে মাসে বেড়েছে ২৬.৬১ শতাংশ

কমেন্ট