পোশাক রপ্তানি: বড় বাজারে ধস, আশা জাগাচ্ছে অপ্রচলিত বাজার
ফাইল ছবি
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মোট রপ্তানির আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে এই বাজার থেকে।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে ৯ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি। দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার জার্মানিতে বেড়েছিল ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ।
কিন্তু সেই সুদিন আর নেই। এই দুই বাজারেই রপ্তানি কমেছে। আর তাতে উদ্বিগ্ন পোশাক রপ্তানিকারকরা। তবে অপ্রচলিত বাজারগুলোতে পোশাক রপ্তানি বেশ বেড়েছে। এতে অবশ্য আশার আলো দেখছেন তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ৭ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি থেকে ৮ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
আর জার্মানিতে জুলাই-মে সময়ে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৬ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার; কমেছে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই বাজারে ৬ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা।
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই বাংলাদেশি পোশাকের বড় বাজার। তবে ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠলে বাজারটিতে রপ্তানি কমে যায়। তবে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে ২০১৯ সালে অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে।
ইতোমধ্যে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নেও ব্যাপক অগ্রগতি হয় বাংলাদেশের। বদৌলতে মহামারি করোনার মধ্যেও ২০২০-২১ অর্থবছরে এই বাজারে ৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এই সময়ে প্রতি বছরেই যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে।
কিন্তু বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসে বেশ ধাক্কা খেয়েছে; নেতিবাচক (নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধিতে চলে গেছে। জার্মানিতেও একই অবস্থা।
তবে ইউরোপের অন্য দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে এখনো ইতিবাচক ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) ইউরোপের ২৭টি দেশে সব মিলিয়ে ২১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি।
এই ১১ মাসে ফ্রান্সে ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ। ইতালিতে বেড়েছে ৪৪ দশমিক ৮১ শতাংশ; রপ্তানি হয়েছে ২ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলারের পোশাক।
জুলাই-মে সময়ে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মধ্যে স্পেনে ৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ; বেড়েছে ১৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অষ্ট্রিয়ায় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। বেলজিয়ামে বেড়েছে ৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ। নেদারল্যান্ডে বেড়েছে ২৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। সুইডেনে বেড়েছে ২০ দশমিক ৫৯ শতাংশ। শতাংশ। আয়ারল্যান্ডে বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
তবে পোল্যান্ডে কমেছে ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ। এই ১১ মাসে দেশটিতে ১ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে পোল্যান্ড থেকে ১ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল।
বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে যুক্তরাজ্যে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। কানাডায় বেড়েছে আরও বেশি ১৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। এসেছে ১ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাজ্য, কানাডার পাশাপাশি ভারত, জাপান, চীন, ব্রাজিল, চিলিসহ ১৫টি অপ্রচলিত বাজারেও পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। এই বাজারগুলোতে জুলাই-মে সময়ে ৭ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩২ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে অন্যতম প্রধান বাজার জাপানে এই ১১ মাসে ১ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাকপণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের বছর সময়ের চেয়ে ৪৫ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ১ বিলিয়ন ডলারের পোশাক।
অপরদিকে জুলাই-মে সময়ে পাশের দেশ ভারতে পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়ে ৯৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি ৪১ দশমিক ৮২ শতাংশ বেড়ে ১ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ৫০ কোটি ডলারের পোশাক; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক ২৫ শতাংশ।
চীনে বেড়েছে ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ; রপ্তানি হয়েছে ২৫ কোটি ২০লাখ ডলারের পোশাক। মালয়েশিয়ায় ৩১ কোটি ৩৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
এই ১১ মাসে তুরস্কে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৫৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সৌদি আরবে বেড়েছে ৩২ শতাংশের বেশি।
এছাড়া ব্রাজিলে বেড়েছে ৫৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। চিলিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। সাউথ আফ্রিকায় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।
শুধু বাংলাদেশ নয়; চীন, ভিয়েতনামসহ সব দেশেরই পোশাক রপ্তানি কমেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়াসহ নানা অস্থিরতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
আর এ কারণেই বিভিন্ন দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি প্রায় এক-চতুর্থাংশ কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড। ফলে এই বাজারে চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে। এই পাঁচ দেশের মধ্যে চীন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি বেশি কমেছে। বাংলাদেশের তুলনামূলকভাবে কম কমেছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে এমন তথ্য মিলেছে। এতে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার ৫২১ কোটি (২৫.২১ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে।
গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এই আমদানি ২২ দশমিক ১৫ শতাংশ কম। গত বছর এই সময়ে ৩ হাজার ২৩৯ কোটি (৩২.৩৯ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক আমদানি করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীন ৪৫২ কোটি (৪.৫২ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। গত বছর একই সময়ে দেশটির রপ্তানি ছিল ৬৬৯ কোটি (৬.৬৯ বিলিয়ন) ডলার। এ হিসাবে এই চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের রপ্তানি কমেছে ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
এই সময়ে দেশটিতে ভিয়েতনামের তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে ৪৩৭ কোটি (৪.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক। গত বছরের একই সময়ে তাদের রপ্তানি ছিল ৬০১ কোটি (৬.০১ বিলিয়ন) ডলার।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালে এই বাজারে ৯৭২ কোটি (৯.৭২ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকাররা। তার বিপরীতে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি হয়েছে ২৭০ কোটি (২.৭০ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই রপ্তানি ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। গত বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছিল ৩২৮ কোটি (৩.২৮ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক।
অন্যদিকে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৭৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে ভারত। দেশটির রপ্তানি কমেছে ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ইন্দোনেশিয়ার তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এই চার মাসে দেশটি রপ্তানি করেছে ১৫১ কোটি ডলারের পোশাক।
গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে। গত বছরের জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়, যা ছিল ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে নিত্যপণ্য ও জ্বালানি ছাড়া অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দেন দেশটির ভোক্তারা।
যদিও দেশটির মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। গত এপ্রিলে অবশ্য তাদের মূল্যস্ফীতি কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়ায়।
সামগ্রিক বিষয় নিয়ে দেশের পোশাকশিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কয়েক মাস ধরেই আমরা বলে আসছি পোশাক রপ্তানিতে একটি মন্দাভাব শুরু হতে যাচ্ছে। গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে সেই প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও কমবে। কেননা, বিশ্ব বিরুপ পরিস্থিতির পাশাপাশি ঈদের ছুটির কারণে এই মাসের ৮/১০ পোশাক কারখানা বন্ধ থাকবে।”
“শেষ পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি কোথায় গিয়ে নামবে, সেটাই এখন চিন্তার বিষয়। তবে অপ্রচলিত বাজারে আমাদের পোশাক রপ্তানি বেশ বেড়েছে। এটা একটা আশার দিক,” বলেন ফারুক হাসান।
কমেন্ট