১১ মাসে ভারতে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার
৩০ জুন শেষে হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। আর পুরো অর্থবছরের (জুলাই-জুন) প্রায় সমান।
২০২১-২২ অর্থবছরে পাশের দেশটিতে ১৯৯ কোটি ১৩ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। জুলাই-মে সময়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১৮৩ কোটি ৪৩ লাখ (১.৮৩ বিলিয়ন) ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রোববার দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৪ শতাংশই এসেছে ভারত থেকে।
এরমধ্যে পাট ও পাটজাতপণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ ৭২ লাখ ডলার। ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৫৪ কোটি ১২ লাখ ডলার। নিট পোশাক থেকে এসেছে ৪০ কোটি ৬৬ লাখ ডলার।
অন্য পণ্যের মধ্যে কটন ও কটন প্রোডাক্টস রপ্তানি থেকে এসেছে ৩ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। প্লাস্টিক দ্রব্য থেকে এসেছে প্রায় ৫ কেোটি ডলার এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ১০ কোটি ৮৩ লঅখ ডলার।
তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-মে সময়ে ভারতে পোশাক রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেড়ে ৯৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার হয়েছে।
এমনিতেই গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে প্রায় ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের মাইলফলকে পৌঁছে। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছিল ৭২ কোটি ডলার (ওভেন ৪০ কোটি ও নিট ৩১ কোটি ৫৬ লাখ ডলার)।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর দেশটিতে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে মাত্র তিনটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়েছে, তাও সেটা গত তিন বছরে। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন, যা ছিল এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। ২০১৯-২০ অর্থবছরের চেয়ে এ আয় বেশি ছিল প্রায় ১৭ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ভারতের বাজারে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। যদিও সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। ২০১১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামিদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এআরএইচ ডটকমে বলেন, “এমনিতেই ভারতে আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে তা আরও বাড়ছে। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই খুশির খবর “
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়িয়েছে। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবকাঠামোগত যোগাযোগের উন্নতিও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।”
তিনি বলেন, “ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নির্ধারিত মান পরিপালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গবেষক আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়বে। একই সঙ্গে এ দেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে।”
একই কথা বলেছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, “আমরা প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত (নতুন) বাজারেও রপ্তানি বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছি। তারই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের পাশাপাশি জাপানসহ অন্যান্য অপ্রচলিত বাজারেও আমাদের রপ্তানি বাড়ছে।”
তিনি বলেন, “গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও ভারতে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য এটা খুবই ভালো। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আমাদের প্রধান দুই বাজার আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা পোশাক রপ্তানিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। ওই দেশগুলোর মানুষ এখন পোশাক কেনা কমিয়ে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় আমরা যদি ভারতে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য খুবই ভালো হবে।”
ফারুক হাসান বলেন, “ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। এখন থেকে তা বাড়তেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। প্রায় দেড়’শ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনছে।”
বাংলাদেশের নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “কিছুদিন আগে ভারতের দুজন বায়ার আমার কারখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। তারা দুজন আমার পুরোনো ক্রেতা। এবার তারা এসেছেন আরও বেশি অর্ডার দিতে।”
“এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতে আমাদের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। আমরা বেশ ভালোভাবেই ভারতের বাজারে প্রবেশ করছি। ভারতের বাজার যদি আমরা মোটামুটি ভালোভাবে ধরতে পারি, তাহলে আর আমাদের পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে না।
“কেননা ভারত আমাদের পাশের দেশ, পরিবহন খরচ খুবই কম পড়বে। আমাদের মুনাফা বেশি হবে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে যদি কখনো কোনো কারণে সমস্যা হয়, তাহলেও আমাদের সমস্যা হবে না।”
কমেন্ট