জাপানে রপ্তানিতে চমক, ২ বিলিয়ন ছাড়াচ্ছে এই অর্থবছরেই
দুই বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে হোঁচট খেলেও জাপানে পণ্য রপ্তানিতে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে দুই বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে হোঁচট খেলেও জাপানে পণ্য রপ্তানিতে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।
৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে (জুলাই-মে) দেশটিতে ১৭৪ কোটি (১.৭৪ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪১ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। আর পুরো অর্থবছরের (জুলাই-জুন) চেয়ে বেশি ২৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে জাপানে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৩৫ কোটি ৩৮ লাখ (১.৩৫ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল। আর ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে এসেছিল ১২৩ কোটি ১৯ লাখ ডলার।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনের রপ্তানি যোগ হলে এই অর্থবছরেই জাপানে বাংলাদেশের রপ্তানি ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের মাইলফলকে পৌঁছবে বলে আশা করছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান।
‘আগামী দিনগুলোতে এই রপ্তানি নতুন উচ্চতায় যাবে’ এমন আশার কথা শুনিয়ে তিনি এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “গত এপ্রিলের শেষ দিকে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি বড় ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল নিয়ে জাপান সফর করেছেন। সেই সফরের মধ্য দিয়ে বন্ধুপ্রতীম দেশ জাপানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর মধ্য দিয়ে জাপানে আমাদের পণ্য রপ্তানি আরও বাড়বে।”
ফারুক হাসান বলেন, “নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এক হাজার একর জমির ওপর গড়ে উঠছে জাপানি অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে কারখানা স্থাপনে চারটি বিদেশি কোম্পানি চুক্তি করেছে। এ ছাড়া জাপানের ৩০টিসহ ৪০টি কোম্পানি বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে।”
“সেদিন বেশি দেরি নয়, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানির মতো জাপানও হবে আমাদের বড় রপ্তানি বাজার,” বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) জাপানে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৭৪ কোটি ডলারের যে বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে, তা বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৮০ কোটি ২৬ লাখ ডলার। ওভেণ পোশাক থেকে এসেছে ৬৫ কোটি ৫২ লাখ ডলার। হোম টেক্সটাইল থেকে এসেছে প্রায় ৪ কোটি ডলার।
এছাড়া চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ১৩ কোটি ১২ লাখ ডলার। পাদুকা থেকে এসেছে ৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলার এবং ক্রাস্টেসিয়ানস রপ্তানি থেকে এসেছে ১ কোটি ১৬ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে জাপানে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১১৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। তার আগের বছরে (২০১৯-২০) আয় হয়েছিল ১২০ কোটি ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছিল ১৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ডলার।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গবেষক সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “জাপানি কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই চীনের বাইরে বিকল্প দেশে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। তারই অংশ হিসেবে ভিয়েতনাম ও ভারতে বিনিয়োগ করছে তারা। এই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে।”
“অন্যান্য দেশের তুলনায় ব্যয় কম হওয়ায় এবং বিশেষায়িত খাতে কর সুবিধা, অভ্যন্তরীণ বাজার ও আঞ্চলিক বাজারে পণ্য রপ্তানির সুযোগ থাকায় জাপানি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। এ ছাড়া জাপানের বাজারেও বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর ভালো সম্ভাবনা আছে।”
“এমন এক প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি জাপান সফর করে এসেছেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে অর্ধশত ব্যবসায়ী নেতার একটি দলও ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে কৃষি, মেট্রোরেল, শিল্প উন্নয়ন, জাহাজ রিসাইক্লিং, মেধাস্বত্ব, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, আইসিটি ও সাইবার–নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং শুল্ক–সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি চুক্তি সই হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই সফর বড় অবদান রাখবে,” বলেন সেলিম রায়হান।
রপ্তানি বাড়ার সুযোগ
পাঁচ বছর আগে জাপান-বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩০১ কোটি ডলার। এর মধ্যে আমদানি ছিল ১৫৭ কোটি ডলার, আর রপ্তানি ১৪৪ কোটি ডলার।
করোনার পর জাপান থেকে পণ্য আমদানি বেড়ে যায়, সেই গতিতে রপ্তানি বাড়েনি। ফলে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। জাপান এক্সটারনাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেটরো) বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে জাপান থেকে ১৫০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়। পরের বছর সেটি ৮৫ কোটি ডলার বাড়ে। গত বছর তো দেশটি থেকে আমদানি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৬০ কোটি ডলার।
অন্যদিকে ২০২০ সালে জাপানে ১৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা পরের বছর বেড়ে ১৪৫ কোটি ডলার হয়। গত বছর বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি দাঁড়ায় ১৭১ কোটি ডলার। এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকেই আসে ১০৯ কোটি ৮৫ লাখ।
অন্য খাতগুলোর মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ৯ কোটি ৩৬ লাখ, হোম টেক্সটাইলে ৪ কোটি ৬৯ লাখ এবং চামড়াবিহীন জুতায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ ডলার আসে।
বিদায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছরের জুলঅই-মে সময়ে জাপানে ১৪৫ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৫ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি।
গত ২০২১-২২ অর্থবছর একই সময়ে এই বাজারে ১০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে জাপানে পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক।
ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের তথ্যানুযায়ী ২০২১ সালে জাপান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে। সেই হিসাবে এই বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি খুবই নগণ্য।
জাপানে প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হওয়া ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলে ছিলেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি এ আরএইচ ডটকমকে বলেন, “ওই সফরের সময় আমরা জাপানের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে নতুন নতুন কোম্পানির সঙ্গে বৈঠক করেছি। ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। আশা করছি তার সুফল আমরা পাব।”
হাতেম বলেন, “চীন থেকে জাপানিরা পোশাকের ব্যবসা সরাচ্ছে। শুরুতে তারা মিয়ানমারে গিয়েছিল। সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বাংলাদেশে পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়িয়েছে জাপানি কোম্পানিগুলো। সে কারণে দেশটিতে রপ্তানি বাড়ছে।”
কমেন্ট