হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে সেই চমক আর নেই

হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে সেই চমক আর নেই

সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে একটি ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটে। পাট, চামড়া, চিংড়ি, কৃষিপণ্যকে পেছনে ফেলে পণ্য রপ্তানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে হোম টেক্সটাইল। কিন্তু কিন্তু সেই জোয়ার আর নেই। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য বলতেই সবার আগে চলে আসে তৈরি পোশাক-গার্মেন্টস পণ্য। কখনো কখনো পাট, হিমায়িত চিংড়ি, চামড়া রপ্তানি নিয়েও আলোচনা হয়; আশার কথা শোনা যায়।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে একটি ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটে। পাট, চামড়া, চিংড়ি, কৃষিপণ্যকে পেছনে ফেলে পণ্য রপ্তানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে হোম টেক্সটাইল; ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার (১.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) বেশি আসে ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।

সেই আশায় ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৮ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। কিন্তু সেই চমক আর নেই। বড় ধাক্কা খেয়েছে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয়।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) এই খাত থেকে ১০২ কোটি ৪৯ লাখ ৮০ হাজার (১.০২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩০ দশমিক ১৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে আরও বেশি, ৪২ দশমিক ৭৪ শতাংশ।

এই ১১ মাসে ১৭৮ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার (১.৭৯ বিলিয়ন) ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরা ছিল। গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে আয় হয়েছিল ১৪৬ কোটি ৭১ লাখ ৯০ হাজার (১.৪৬ বিলিয়ন) ডলার।

করোনাকালে চীন ও ভারতের বাজার বাংলাদেশে চলে আসায় হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতে উল্লম্ফন হয়েছিল বলে জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ হোম টেক্সটাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও অ্যাপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুন-অর-রশিদ।

এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “সত্যি কথা বলতে কী আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম! পর পর দুই বছর আমাদের এই খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় ৫০ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা দেড় বিলিয়ন ডলারও ছাড়িয়ে যায়। আমরা আশা করেছিলাম এবার এই খাত থেকে আয় ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। মনে হয় না আর কোনো দিন এই খাত থেকে ২ বিলিয়ন ডলার দেশে আসবে।”

কেন এই খাত থেকে আয় কমছে- এ প্রশ্নের উত্তরে হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘গ্যাস-বিদ্যুৎসংকটের কারণে অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্টের পর অনেক কারখানাই চাহিদা অনুযায়ী পণ্য রপ্তানি করতে পারেনি। এ ছাড়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশেও ভাটা পড়েছে। যেসব দেশে আমরা আমাদের পণ্য রপ্তানি করি, সেসব দেশের মানুষের এখন খাদ্য ও জ্বালানির পেছনেই অনেক বেশি অর্থ চলে যাচ্ছে। অতি প্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য কিনছে না তারা। সে কারণেই হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমে গেছে।”

ইপিবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, করোনার আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৮৫ কোটি ডলারের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হয়। পরের বছর করোনা মহামারির কারণে তা কমে ৭৬ কোটি ডলারে নামে।

এর পরের দুই বছরে অবশ্য রপ্তানি দ্রুতগতিতে বেড়েছে।এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি ৪৯ দশমিক ১৭ শতাংশ বেড়ে ১১৩ কোটি ডলারে ওঠে। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আরও বেড়ে ১৬২ কোটি ডলারে উন্নীত হয়:  প্রবৃদ্ধি হয় ৪৩ শতাংশ।

হঠাৎ করে হোম টেক্সটাইলের রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা জানান, করোনার প্রকোপ কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর গত বছর প্রচুর ক্রয়াদেশ পান বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। তখন করোনার কারণে সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় চীন থেকেও প্রচুর ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হয়।

রাজনৈতিক অস্থিরতা, গ্যাস-বিদ্যুৎসংকট ও পাকিস্তানি রুপির টালমাটাল অবস্থার কারণে সেই দেশের ব্যবসাও পায় বাংলাদেশ।

দেশের মোট হোম টেক্সটাইল রপ্তানির ৭০ শতাংশই রপ্তানি করে জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ জোবায়ের এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমাদের মূল বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউর দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি ব্যাপক হারে বেড়েছে। সেখানকার ভোক্তারা নিত্যপণ্যের বাইরে অন্যান্য পণ্যের কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন। এর প্রভাব ক্রয়াদেশে পড়েছে। তাতে আগামী দিনে রপ্তানি কমে যেতে পারে।”

হোম টেক্সটাইল পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিছানার চাদর, বালিশের কভার, দরজা-জানালার পর্দা, কুশন ও বিভিন্ন ধরনের টেরিটাওয়েল। বর্তমানে বিশ্বের ১২৫টি দেশে বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। তবে আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নই (ইইউ) হচ্ছে বড় বাজার।

হোম টেক্সটাইল খাতে দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বর্তমানে পণ্য রপ্তানি করছে ৫০-৬০টি।

জাবের অ্যান্ড জোবায়ের ফেব্রিকস এবং অ্যাপেক্স উইভিং অ্যান্ড ফিনিশিং মিলস ছাড়াও সাদ গ্রুপ, অলটেক্স, এসিএস টেক্সটাইল, জে কে গ্রুপ, ক্লাসিক্যাল হোম, ইউনিলাইন হোম টেক্সটাইল বস্ত্রপণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি করছে।

হোম টেক্সটাইল আসলে কী

হোম টেক্সটাইল বলতে বোঝায় ঘরের অন্দরের শোভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহার করা বস্ত্রপণ্য। এ কারণে এ ধরনের পণ্যকে হোমটেক্স বা ঘরোয়া টেক্সটাইলও বলা হয়ে থাকে। বিছানার চাদর, বালিশ, বালিশের কাভার, টেবিল ক্লথ, পর্দা, ফ্লোর ম্যাট, কার্পেট, জিকজাক গালিচা, ফার্নিচারে ব্যবহার করা ফেব্রিকস, তোশক, পাপোশ, খাবার টেবিলের রানার, কৃত্রিম ফুল, নকশি কাঁথা, খেলনা, কম্বলের বিকল্প কমফোর্টার, বাথরুম টাওয়েল, রান্নাঘর ও গৃহসজ্জায় ব্যবহার হয় এমন সব পণ্য এ খাতের আওতাভুক্ত।

এ শিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলা, পাট, শন, রেশম, ভেড়া-ছাগলের পশম, অন্যান্য পশম। এ ছাড়া সম্প্রতি কৃত্রিম তন্তুর ব্যবহারেও হোম টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন হচ্ছে দেশে।

প্রধান বাজার বড় ব্র্যান্ড

বৈশ্বিক হোম টেক্সটাইলের প্রধান বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকা। মোটের ৬০ শতাংশ ব্যবহার হয় দুই মহাদেশের দেশগুলোতে। বাংলাদেশের হোম টেক্সটাইলের ৮০ শতাংশ যায় এ দুই বাজারে।

বিশ্বখ্যাত ক্যারফোর, ওয়ালমার্ট, আইকিয়া, আলদি, এইচঅ্যান্ডএম, মরিস ফিলিপস, হ্যামার মতো বড় ব্র্যান্ড এখন বাংলাদেশের হোম টেক্সের বড় ক্রেতা। অন্যান্য খুচরা ক্রেতার সংখ্যাও কম নয় বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা। রপ্তানি খাতের অন্যান্য পণ্যের মতো যুক্তরাষ্ট্র বাদে সব বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পায় হোম টেক্সটাইল।

১২ বছরের রপ্তানির চিত্র

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে আয় হয় ১১৩ কোটি ২০ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই খাত থেকে ৭৫ কোটি ৮৯ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আয়ের অঙ্ক ছিল একটিু বেশি ৮৫ কোটি ১৭ লাখ ডলার।

২০১৭-১৮, ২০১৬-১৭ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল যথাক্রমে ৮৭ কোটি ৮৬ লাখ, ৭৯ কোটি ৯১ লাখ ও ৭৫ কোটি ৩০ লাখ ডলার।

আগের তিন বছর ২০১২-১৩, ২০১১-১২ এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে এই খাত থেকে বাংলাদেশ ৭৯ কোটি ১৫ লাখ, ৯০ কোটি ৬০ লাখ এবং ৭৮ কোটি ৮৭ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছিল।

এবার ঐহিত্যবাহী জামদানি মসলিন দিয়ে বিশ্ব জয়ের আশা পরবর্তী

এবার ঐহিত্যবাহী জামদানি মসলিন দিয়ে বিশ্ব জয়ের আশা

কমেন্ট