রপ্তানি আয়: পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই ধস

রপ্তানি আয়: পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই ধস

প্রায় দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধেও রপ্তানি বাণিজ্যে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৮ লাখ (৫৫.৫৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন দেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কোনো অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি। তবে দুঃসংবাদ হচ্ছে, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানিতে ধস নেমেছে; চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য- সব খাতেই আগের অর্থবছরের চেয়ে আয় কমেছে। 

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বিদায়ী অর্থবছরের ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার  রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। অর্থাৎ মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে এই খাত থেকে। 

সার্বিক রপ্তানিতে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা আসলে পোশাক খাতের উপর ভর করেই অর্জিত হয়েছে। 

তৈরি পোশাকের মধ্যে ২৫ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে; প্রবৃদ্শি হয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে এই খাত থেকে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। মোট রপ্তানি আয়ের ৪৬ দশমিক ৩৩ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় এসেছে দশমিক ৪১ শতাংশ। 

ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ; লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে দশমিক ৫৪ শতাংশ। এই খাত থেকে ২১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে।

২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন রপ্তানিকারকরা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৫৮ বিলিযন ডলার।   

জুনে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় 

বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় আবার ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার ছাড়িয়েছে; এসেছে ৫০৩ কোটি ১৫ লাখ ৩০ হাজার (৫.০৩ বিলিয়ন) ডলার।  

এই অঙ্ক গত বছরের জুন মাসের চেয়ে ২ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ কম।

একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশে এর আগে কেবল তিন  মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছিলেন রপ্তানিকারকরা। মাস ৩টি হচ্ছে- গত বছরের নভেম্বর (৫.০৯ বিলিয়ন ডলার), ডিসেম্বর (৫.৩৬ বিলিয়ন ডলার) এবং জানুয়ারি (৫.১৩ বিলিয়ন ডলার)। 

এতেে দেখা যাচ্ছে, এক মাসের হিসাবে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বরে।  

বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাস জুনে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জুনে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৪ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার।  

সাধারণত দুই ঈদের মাসে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বাড়লেও রপ্তানি আয় কমে যায়। কেননা, রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক কারখানা ঈদ উপলক্ষ্যে ৮/১০ দিন বন্ধ থাকে। এ সময়ে পোশাক উৎপাদন কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস হাউজ, ব্যাংক-বিমাসহ রপ্তানি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রতিষ্ঠানও কিছুদিন বন্ধ থাকে। 

কিন্তু এবার তার উল্টোটা ঘটেছে। ২৯ জুন দেশে কোরবানির ঈদ উদযাপিত হয়েছে। ২৫/২৬ জুন থেকে পোশাক কারখানাগুলোতে ছুটি শুরু হয়। সে হিসাবে প্রায় এক সপ্তাহ কারখানাগুলোতে পুরোদমে উৎপাদন হয়নি।  

তারপরও জুন মাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় রপ্তানিকারকদের অবাক করে দিয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও এক মাসে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয়ে আমরা খুবই খুশি। ঈদের ছুটিতে কয়েকদিন কারখানা বন্দ থাকার পরও এই আয় আমাদের সত্যিই অবাক করে দিয়েছে।”  

“তবে আগামী দিনগুলোতে এই ইতিবাচক ধারা থাকবে বলে মনে হয় না। কেননা, বিশ্ব পরিস্থিতি অনুকুলে নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষ্যণ নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তনি কমছে। ইউরোপের দেশগুলোতেও প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। জানি না কী হবে,” বলেন বিজিএমইএ প্রধান। 

“অন্যান্য খাতে প্রবৃদ্ধি হলে এবার মোট রপ্তানি আয় ৫৮ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৬০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকত।” 

চামড়া খাত 

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়,তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য বড় খাতগুলোর মধ্যে শুধু চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে থেকে বিদায়ী অর্থবছরে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে আরও বেশি, ১৫ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। 

২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১৪৪ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের আয় হয়েছিল ১২৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার। 

পাট খাত 

প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সোনালি আঁশ হিসেবে পরিচিত পাট খাতের।২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ; আয় হয়েছে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার। 

নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১২৮ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের আয় হয়েছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

হোম টেক্সটাইল 

সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে একটি ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটে। পাট, চামড়া, চিংড়ি ও কৃষিপণ্যকে পেছনে ফেলে পণ্য রপ্তানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে হোম টেক্সটাইল; ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার (১.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে বেশি আসে ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ। 

সেই আশায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৮ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরে সরকার। কিন্তু সেই চমক আর নেই। বড় ধাক্কা খেয়েছে হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতেও। 

বিদায়ী অর্থবছরের এই খাত থেকে ১০৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে আরও বেশি, ৪৪ দশমিক ৬৮  শতাংশ।

অন্যান্য খাত 

অন্যান্য খাতের মধ্যে সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় কমেছে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৩৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। 

২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১ বিলিয়ন ডলারের কম, ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে।

হিমায়িত মাছ রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। এই খাত থেকে এবার মাত্র ৪২ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ৫৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার। 

এ ছাড়া ওষুধ রপ্তানি থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় কমেছে ৭ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বাইসাইকেল রপ্তানি ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং হ্যান্ডিক্রাফট থেকে রপ্তানি আয় কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি। 

  

 

দ্রব্যমূল্য নিয়ে সংসদে তোপের মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী পরবর্তী

দ্রব্যমূল্য নিয়ে সংসদে তোপের মুখে বাণিজ্যমন্ত্রী

কমেন্ট