রপ্তানি আয়: অর্ধেকই এসেছে নিট পোশাক থেকে

রপ্তানি আয়: অর্ধেকই এসেছে নিট পোশাক থেকে

৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার মোট রপ্তানি আয়ের ৪৬ দশমিক ৩৩ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে। ফাইল ছবি

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৮ লাখ (৫৫.৫৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন দেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। 

অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল, তার চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি এসেছে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে। 

আর এটি সম্ভব হয়েছে মূলত কম দামি পোশাক রপ্তানির উপর ভর করে। প্রায় দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় তছনছ হয়ে যাওয়া বিশ্ববাজারে অতিপ্রয়োজনীয় কম দামের পোশাক বিশেষ করে নিট পোশাক রপ্তানি বাড়ার কারণে রপ্তানি বাণিজ্যে একটি স্বস্তির বছর পার করেছে বাংলাদেশ। 

বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কোনো অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি করে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি। তবে দুঃসংবাদ হচ্ছে, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানিতে ধস নেমেছে; চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য- সব খাতেই আগের অর্থবছরের চেয়ে আয় বেশ কমেছে। 

২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন-পুরো অর্থবছর জুড়েই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার ব্যাপক দরপতন হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতার সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছিল। মূল্যস্ফীতির পারদ প্রায় ১০ শতাংশে উঠেছিল। 

এই সংকটের মধ্যেও রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক রপ্তানির ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সোমবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা  বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া অর্থবছরের ৫৫.৫৬ বিলিয়ন ডলার  রপ্তানি আয়ের মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। অর্থাৎ মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে এই খাত থেকে।

 

এরমধ্যে প্রায় অর্ধেক ২৫ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারই এসেছে কম দামি পোশাক নিট পোশাক থেকে; প্রবৃদ্ধি  হয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। অর্থাৎ বিদায়ী অর্থবছরে আগের বছরের চেয়ে এই খাত থেকে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। 

৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার মোট রপ্তানি আয়ের ৪৬ দশমিক ৩৩ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় এসেছে দশমিক ৪১ শতাংশ।  

ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ; লক্ষ্যের চেয়ে বেশি এসেছে দশমিক ৫৪ শতাংশ। এই খাত থেকে ২১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। 

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে, তার মধ্যে ৫৫ শতাংশই এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে। 

বিদায়ী অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৫৮ বিলিযন ডলার।  তৈরি পোশাক থেকে আয়ের লক্ষ্য ছিল ৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।

২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন রপ্তানিকারকরা। এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকে এসেছিল ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। 

চামড়া খাত  

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়,তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য বড় খাতগুলোর মধ্যে শুধু চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে থেকে বিদায়ী অর্থবছরে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে আরও বেশি, ১৫ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।  

২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ১৪৪ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের আয় হয়েছিল ১২৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার।  

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের দুটি উপখাত ওভেন ও নিট। আগে নিটের চেয়ে ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসত। বেশ কয়েক বছর ধরে রপ্তানি বাণিজ্যে এই দুই খাতের অবদান ছিল কাছাকাছি। 

কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে ওভেনকে পেছনে ফেলে ওপরে উঠে আসে নিট খাত। 

ইপিবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি থেকে মোট ২৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ওভেন পোশাক থেকে এসেছিল ১৪ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার। আর নিট পোশাক থেকে এসেছিল ১৩ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। 

২০২০-২১ অর্থবছরে পাল্টে যায় চিত্র; নিট থেকে আসে প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। আর ওভেন থেকে আসে ১৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। 

পাট খাত  

প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সোনালি আঁশ হিসেবে পরিচিত পাট খাতের।২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ; আয় হয়েছে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার।  

নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ। এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১২৮ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরের আয় হয়েছিল ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার।

হোম টেক্সটাইল  

সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে একটি ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটে। পাট, চামড়া, চিংড়ি ও কৃষিপণ্যকে পেছনে ফেলে পণ্য রপ্তানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে হোম টেক্সটাইল; ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার (১.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে বেশি আসে ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।  

সেই আশায় চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৮ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরে সরকার। কিন্তু সেই চমক আর নেই। বড় ধাক্কা খেয়েছে হোম টেক্সটাইল রপ্তানিতেও।  

বিদায়ী অর্থবছরের এই খাত থেকে ১০৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে আরও বেশি, ৪৪ দশমিক ৬৮  শতাংশ। 

অন্যান্য খাত  

অন্যান্য খাতের মধ্যে সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে আয় কমেছে ২৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৩৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।  

২০২১-২২ অর্থবছরে এই খাত থেকে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি, ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা ১ বিলিয়ন ডলারের কম, ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারে নেমে এসেছে। 

হিমায়িত মাছ রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ২১ শতাংশ। এই খাত থেকে এবার মাত্র ৪২ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছিল ৫৩ কোটি ২৯ লাখ ডলার।  

এ ছাড়া ওষুধ রপ্তানি থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আয় কমেছে ৭ দশমিক শূন্য আট শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ, বাইসাইকেল রপ্তানি ১৫ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং হ্যান্ডিক্রাফট থেকে রপ্তানি আয় কমেছে ৩০ শতাংশের বেশি।  

নিট পোশাক রপ্তানি বাড়ছে কেন 

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমরা নিজেরাও ভাবিনি নিট খাতের রপ্তানি এতটা বাড়বে। দুই বছরের করোনা মহামারির মধ্যেও দেশের রপ্তানি আয়ের যে উল্লম্ফন হয়েছিল, তা কিন্তু নিট পোশাকের ওপর ভর করেই হয়েছিল। এখন যুদ্ধের মধ্যে সেটা অব্যাহত আছে।” 

তিনি বলেন, “মানুষ যত সমস্যায়ই থাকুক, যত অর্থ সংকটেই থাকুক না কেন, অতি প্রয়োজনীয় কাপড় কিনতেই হয়। সে কারণে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় বাড়ছে।” 

“যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। সে কারণে ওই সব দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তারা এখন খাদ্য ও অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া অন্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছে।’ 

“নিট পোশাক যেহেতু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য, তাই তারা বাধ্য হয়ে এগুলো কিনছে,” বলেন মোহাম্মদ হাতেম। 

ওভেন পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি ও এভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ এআরএইচ ডটকমকে  বলেন, ‘বিশ্বের সব দেশের অর্থনীতিতেই সংকট চলছে। এই যুদ্ধটা সবকিছু ওলোটপালট করে দিয়েছে। সংকটের এই সময়ে বায়াররা অতি প্রয়োজনীয় পোশাক বেশি কিনেছেন। সে কারণে নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে।” 

নিত্যপ্রয়োজনীয় পোশাকই আসলে নিট পোশাক। সাধারণ কথায় গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি পোশাকই নিট। যেমন টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার, শর্টস প্রভৃতি। 

অন্যদিকে ফরমাল শার্ট, প্যান্ট, স্যুট, ডেনিম প্রভৃতি ওভেন পোশাক হিসেবে পরিচিত। 

  

   

 

রপ্তানি আয়: পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই ধস পরবর্তী

রপ্তানি আয়: পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই ধস

কমেন্ট