সোনালী আঁশের সোনালী দিনের আশায় গুড়েবালি
এক ধাক্কায় পাট খাত থেকে রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে রপ্তানি পণ্য তালিকায় চতুর্থ স্থানে নেমে গেছে। ফাইল ছবি
বাংলাদেশের সোনালি আঁশ পাটের ‘সোনালি দিন’ ফিরে আসার হাতছানি দেখা দিয়েছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। ওই অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে রপ্তানি তালিকায় চামড়াকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল এই খাত। আগের অর্থবছরের (২০১৯-২০) চেয়ে রপ্তানি বেড়েছিল ৩১.৬৩ শতাংশ।
কিন্তু দুই বছর যেতে না যেতেই সেই সুদিন ফুরিয়ে গেছে। এক ধাক্কায় এই খাত থেকে রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের নিচে নেমে রপ্তানি পণ্য তালিকায় চতুর্থ স্থানে নেমে গেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া সদ্য বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯১ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলার আয় করেছেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা।
এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ কম। আর ১২৮ কোটি (১.২৮ বিলিয়ন) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১১২ কোটি ৭৬ লাখ (১.১২ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল। তার আগে ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসেছিল ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ খাত থেকে ৮১ কোটি ৬৩ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে পাট ও পাট পণ্য রপ্তানি করে ১০২ কোটি (১.০২ বিলিয়ন) ডলার বিদেশি মুদ্রা আয় করেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে ওই প্রথম এই খাত থেকে রপ্তানি আয় ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৯৬ কোটি ২০ লাখ ডলার। তার আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এসেছিল ৯২ কোটি ডলার।
পাটকল মালিক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পাটপণ্যের চাহিদা কমে গেছে। বেড়ে গেছে পলি ফাইবারের চাহিদা। সে কারণে পাটপণ্যের দাম ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে গেছে। সে কারণে রপ্তানিতেও ধস নেমেছে।
বিশ্ববাজারে পাটপণ্যের চাহিদা না বাড়লে দামও বাড়বে না। সে কারণে আগামী দিনগুলোতে এ খাতের রপ্তানি আয় বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না রপ্তানিকারকরা। দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ওলোটপালট হয়ে যাওয়া বিশ্ব অর্থনীতি এ খাতের রপ্তানি আয় কমার আরেকটি কারণ বলে জানান তারা।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট পণ্য রপ্তানি থেকে ৯১ কোটি ২২ লাখ ডলার যে আয় হয়েছে, তার মধ্য পাটসুতা (জুট ইয়ার্ন) রপ্তানি হয়েছে ৪৯ কোটি ৭৯ লাখ ৪০ হাজার ডলারের, আয় কমেছে ২৮.৬৪ শতাংশ। লক্ষ্যের চেয়ে কমেছে ৩৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাটসুতা রপ্তানি থেকে প্রায় ৭০ কোটি ডলার আয় হয়েছিল।
গত অর্থবছরে পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১০ কোটি ৯৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার। কমেছে ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ১৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে রপ্তানি করে আয় হয়েছিল প্রায় ১২ কোটি ডলার।
২০২২-২৩ অর্থবছরে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২০ কোটি ৪১ লাখ ৭০ হাজার ডলার। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম প্রায় ১৫ শতাংশ।
বিজেএমসি উৎপাদনে নেই, রপ্তানিও নেই
বছরের পর বছর লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) ২৫টি পাটকল ২০২০ সালের ১ জুলাই বন্ধ করে দেয় সরকার।
রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো পাটকল এখন উৎপাদনে নেই। সে কারণে সরকারিভাবে পাট ও পাটজাত পণ্য এখন আর রপ্তানি হয় না। অথচ বন্ধ হওয়ার আগে বিজেএমসির পাটকলগুলো থেকে এ খাতের রপ্তানির ২০ শতাংশের মতো আসত।
হতাশ রপ্তানিকারকরা
বাংলাদেশ পাটপণ্য রপ্তানিকারক সমিতির (বিজেজিইএ) চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসাইন সোহেল এআর্লেএ্ইচ ডটকমকে বলেন, “২০২০-২১ অর্থবছরে রপ্তানি বাড়ায় আমরা আশায় বুক বেঁধেছিলাম, আমাদের সোনালি আঁশ পাটের সুদিন হয়তো ফিরে আসতে শুরু করেছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সে আশায় গুড়েবালি।
“সবাই আশা করেছিল, কোভিড-১৯ মহামারি পরিবেশের ক্ষেত্রে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়ায় পাটপণ্যের চাহিদা অনেক বেড়ে যাবে। এ খাতের সম্ভাবনাও দেখা দেবে নতুন করে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, বিভিন্ন দেশের ক্রেতারা পাটের পরিবর্তে কটন ও সিল্ক দিয়ে তৈরি পণ্য কিনছেন। পলি ফাইবারও ব্যবহার করছেন অনেকে। পাটজাত পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় এ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন ক্রেতারা।"
একই কথা বলেন বেসরকারি পাটকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান করিম জুট মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহিদ মিয়া।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার মনে হয় না, ২০২০-২১ অর্থবছরের মতো পাট খাত থেকে রপ্তানি আয় আর কখনও দেশে আসবে। এত দিন ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ পরিবেশের বিষয়টি মাথায় রেখে পাটের তৈরি বস্তা, চট ও থলে ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে তারা আবার পলি ফাইবার, কটন ও সিল্কের তৈরি পণ্য কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে। জানি না, পাটের রপ্তানি বাজারের ভবিষ্যৎ কী হবে।”
দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ স্থানে পাট
২০২০-২১ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ১৫ লাখ ডলার আয় করে চামড়া খাতকে পেছনে ফেলে রপ্তানি পণ্য তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে গিয়েছিল পাট খাত।
এবার এই খাত ৯১ কেটি ২২ লাখ ৫০ হাজার ডলার রপ্তানি করে চতুর্থ স্থানে নেমে এসেছে।
বিদায়ী অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ সব মিলিয়ে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে তৈরি পোশাক শিল্প খাত থেকে।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে পোশমাক খাত থেকে।
অন্যাান্য খাতের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ১ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার। হোম টেক্সটাইল থেকে এসেছে ১ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ডলার
কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ৮৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার। হিমায়িত মাছ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪২ কোটি ২৩ লাখ ডলার।
কমেন্ট