সম্ভাবনার ওষুধ রপ্তানিতে হতাশা
গত অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করেছেন ওষুধ রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ২৩ শতাংশ।
রপ্তানি বাণিজ্যে বেশ আশা জাগিয়েছিল ওষুধ খাত। প্রতিবছরই বাড়ছিল রপ্তানি। বেক্সিমকো, স্কয়ার, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসসহ প্রথম সারির প্রায় সব কোম্পানিই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ রপ্তানি করছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ কোটি ১৮ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি। আর সেই সম্বাবনাকে সামনে রেখে গেলো ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ধরা হয় ২৩ কোটি ডলার।
কিন্তু সে আশা গুড়েবালি। ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করেছেন ওষুধ রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক শূন্য আট শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম আরও বেশি প্রায় ২৩ শতাংশ।
দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই গত মার্চ মাসে ঢাকায় ‘বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলন’ নামে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, সেই সম্মেলনেও ওষুধ রপ্তানি নিয়ে সমূহ সম্ভাবনা ও আশার কথা শুনিয়েছিলেন এ খাতের উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
কিন্তু রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) যে তথ্য প্রকাশ করছে, তাতে তার কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে মাত্র ৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ১০ বছরের ব্যবধানে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই আয় পাঁচ গুণের বেশি বেড়ে প্রায় ১৯ কোটি ডলারে ওঠে। কিন্তু সেই ইতিবাচক ধারায় হোঁচট খেয়েছে।
তবে শুধু ওষুধ নয়, তৈরি পোশাক ছাড়া সব খাতেই রপ্তানি আয় কমেছে। সারা বিশ্বে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় করোনাভাইরাস নিরোধক ওষুধ রপ্তানি না হওয়ায় এ খাতের রপ্তানি নিম্নমুখী হয়েছে বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকরা।
হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ঔষধশিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “করোনার ওষুধ রপ্তানি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভালো আয় করেছিলাম আমরা। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এ ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে না। তাই আয় কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছে। অন্য কোনো কারণ নেই।”
“বিভিন্ন দেশে আমাদের ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। করোনার ওষুধ রপ্তানি না হলেও আগামী দিনগুলোতে আমাদের রপ্তানি বাড়বে। গত অর্থবছরে হয়তো নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে আমাদের ওষুধ রপ্তানি অবশ্যই বাড়বে বলে আমরা আশা করছি।”
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, প্রতিবছরই ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে। তবে ২০১৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩২ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে ছাড় (মেধাস্বত্ব অধিকার-ট্রিপস) দেয়ার পর থেকে এ খাতের রপ্তানির পালে বাড়তি হাওয়া লাগে। এরপর করোনা চিকিৎসার ওষুধ রপ্তানি করে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় ওষুধ খাত।
করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের বিভিন্ন শিল্প খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও ঔষধশিল্পে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। উল্টো করোনা এ খাতে আশীর্বাদই বয়ে এনেছিল বলা যায়। অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়ছিল সমানতালে। রপ্তানি পণ্যের তালিকায় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের অন্তর্ভুক্তি, গুণগত মানের উন্নয়ন ও সরকারের নীতি-সহায়তার কারণে সুবাতাস বইছিল এ খাতে।
ঔষধশিল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে কেবল কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রপ্তানি থেকেই আয় হয়েছিল প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৫০০ কোটি টাকার মতো দাঁড়ায়। বাংলাদেশ মূলত ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, ক্যানসার, কুষ্ঠরোগ, অ্যান্টি-হেপাটিক, পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, কিডনি ডায়ালাইসিস, হোমিওপ্যাথিক, বায়োকেমিক্যাল, আয়ুর্বেদিক ও হাইড্রোসিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওষুধ রপ্তানি করে থাকে।
২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর থেকে এ তালিকায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধক ওষুধ যুক্ত হয়, ফলে এ শিল্পে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। গত ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত তা অব্যাহত ছিল। কিন্তু বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি স্বাভাবিক হয়ে আসায় করোনাভাইরাস প্রতিরোধক ওষুধ আর এখন রপ্তানি হচ্ছে না।
সে কারণেই এ খাত থেকে রপ্তানি আয় কমেছে বলে জানান ঔষধশিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান। তবে এতে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ঔষধশিল্পের অগ্রগতি এখন গর্ব করার মতো। বাংলাদেশ শুধু নিজেদের ওষুধ নিজেরাই উৎপাদন করে না বরং বিশ্বের শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা ৭০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতাম। এখন দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মানসম্মত ওষুধ রপ্তানি করছে।”
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, আগের বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় গত ২০২১-২২ অর্থবছরেও ওষুধ রপ্তানির ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। ওই অর্থবছরে এ খাত থেকে ১৮ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরা ছিল। আয় হয়েছিল ১৮ কোটি ৮৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার। সে হিসাবে লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছিল প্রায় ৫ শতাংশ। আগের অর্থবছরের চেয়ে বেশি এসেছিল ১১ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
২০২০-২১ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১৬ কোটি ৯০ লাখ ২০ হাজার ডলার।
ঔষধশিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ওষুধ রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশই দখল করে আছে বেক্সিমকো। দ্বিতীয় অবস্থানে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। এ ছাড়া স্কয়ার, এসকেএফ, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস, একমি ল্যাবরেটরিজসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওষুধ রপ্তানি করে থাকে।
গত মার্চ মাসে এফবিসিসিআই আয়োজিত ব্যবসা সম্মেলনের ওষুধ খাত নিয়ে একটি বিশেষ অধিবেশন হয়। সেখানে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি বাড়ার সম্ভবানা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়। ওই অধিবেশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের ৩০০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের মোট আটজন মন্ত্রী অংশ নেন এ সম্মেলনে।
‘বাংলাদেশে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা: প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক সংযুক্তি ও এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বিনিয়োগের সুযোগ’ শীর্ষক ওই অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান। আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকি আবদুল মুক্তাদির।
অধিবেশনে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বৈশ্বিক ওষুধের বাজারের ১০ শতাংশ হিস্যার ভাগীদার হওয়ার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানে ওষুধ উৎপাদনে ভারতকে বলা হয় বিশ্বের ফার্মেসি। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন ওষুধের জন্য ভারতের বাইরে নতুন দেশ অর্থাৎ ভারত প্লাস খুঁজছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ হতে পারে ওষুধ উৎপাদনে বড় ধরনের সম্ভাবনাময় দেশ।
কারণ, এ দেশে আছে সস্তা শ্রম, যা চীন ও ভারত কারোরই নেই। বাংলাদেশে অল্প খরচে উন্নত মানের ওষুধ তৈরি হয়। দেশের বাজারে প্রথম থেকে দশম অবস্থানে থাকা কোম্পানির হাতেই দেশের ওষুধের বাজারের ৭০ শতাংশের হিস্যা রয়েছে। তবে প্রথম থেকে পঞ্চম অবস্থানে থাকা কোম্পানিগুলোর হিস্যাই ৫২ শতাংশ।
বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয় বিশ্বের ১৫৭টি দেশে। দেশের ২৬৫টি নিবন্ধিত ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ২১৩টিই উৎপাদনে রয়েছে। দেশের মোট ওষুধ চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ হয় দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে। বাকি ৩ শতাংশ আমদানি করতে হয়।
২০২২ সালে এ খাতের বাজারটি ছিল ৩৩২ কোটি ডলারের। ২০২৭ সালে এ বাজারের আকার বেড়ে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৬৬৮ কোটি ডলারে উন্নীত হবে।
অনুষ্ঠানে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি আবদুল মুক্তাদির বলেন, “ওষুধের বৈশ্বিক বাজার ৪০ হাজার কোটি ডলারের। যদি আমরা বৈশ্বিক বাজার চাহিদার ১ শতাংশও রপ্তানি করতে পারি তবে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় আসবে ৪০০ কোটি ডলার। চীনের ওষুধের বাজার ২২ হাজার কোটি ডলারের। আর ভারতের বাজার ৪ হাজার কোটি ডলারের। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এ দুই দেশের পক্ষে বৈশ্বিক চাহিদা মেটানো সহজ নয়।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নাজমুল হাসান বলেন, “গত কয়েক বছরে চীনে ওষুধ খাতের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের বেতন-মজুরি ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। বেতন ও মজুরি বৃদ্ধিতে ভারতও উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সস্তা শ্রম রয়েছে। তাই সস্তায় উন্নত মানের ওষুধ তৈরির অন্যতম বৈশ্বিক কেন্দ্র হওয়ার সব ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।
কমেন্ট