ভারতে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছাড়াল
বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য বেশি হয়ে থাকে। ফাইল ছবি
ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হওয়ার সুখববের মধ্যেই আরেকটি সুসংবাদ এসেছে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে। বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ ভারতে পণ্য রপ্তানিতে নতুন মাইলফলক অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সদ্য সমাপ্ত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাশের দেশটিতে ২১২ কোটি ৯৫ লাখ (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।
এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়নি।
২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল।
এমনিতেই ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। চার বছরের মাথায় সেই আয় দ্বিগুন হয়ে ২ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলকে পৌঁছেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর দেশটিতে পণ্য রপ্তানির পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে। দেশটির সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। টাকাতেও লেনদেন শুরু হবে কিছু দিন পর। সব মিলিয়ে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়বে বলে আশার কথা শুনিয়েছেন তারা।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বুধবার রপ্তানি আয়ের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্র্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানিতে বড় ধরনের সাফল্যের পেছনে তৈরি পোশাক বড় ভূমিকা রেখেছে। মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেক, ৪৭ দশমিক ৪২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
মোট ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার আয়ের মধ্যে ১ দশমিক শূন্য এক বিলিয়ন ডলারই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এর মধ্যে ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৫৮ কোটি ৭ লাখ ডলার। নিট পোশাক থেকে এসেছে ৪৩ কোটি ২২ লাখ ডলার।
এছাড়া পাট ও পাটজাতপণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার, কটন ও কটন প্রোডাক্টস থেকে এসেছে ৩ কোটি ৯১ লাখ ডলার। প্লাস্টিক দ্রব্য থেকে এসেছে ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৩০ হাজার ডলার। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি এসেছে ১১ কোটি ৯২ লাখ ২০ হাজার ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে মাত্র চারটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়েছে, তাও সেটা গত চার বছরে। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। যদিও সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। ২০১১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট।
সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে। কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামিদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এমনিতেই ভারতে আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল। গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে তা আরও বাড়ছে। চার বছর আগে ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিলা। এবার ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়াল। ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুবই খুশির খবর।”
তিনি বলেন, “ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে টাকাতেও লেনদেন হবে। সব মিলিয়ে ভারত আমাদের পণ্য রপ্তানির একটি বড় বাজার হয়ে উঠবে।”
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সে কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়ায়। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবকাঠামোগত যোগাযোগের উন্নতিও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে।”
তিনি বলেন, “ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নির্ধারিত মান পরিপালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গবেষক আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়বে। একই সঙ্গে এ দেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে।”
রুপিতে বাণিজ্য শুরু হওয়ার রপ্তানি বাড়াতে অবদান রাখবে বলে মনে করছেন এই অর্থনীতিবিদ।
একই কথা বলেছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, “আমরা প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত (নতুন) বাজারেও রপ্তানি বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছি। তারই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য অপ্রচলিত বাজারেও আমাদের রপ্তানি বাড়ছে।”
তিনি বলেন, “গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় চলতি অর্থবছরেও ভারতে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। সে কারণেই ২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করা সম্ভব হয়েছে। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমাদের জন্য এটা খুবই ভালো।”
“রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আমাদের প্রধান দুই বাজার আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা পোশাক রপ্তানিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। ওই দেশগুলোর মানুষ এখন পোশাক কেনা কমিয়ে দিচ্ছেন। এ অবস্থায় আমরা যদি ভারতে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়াতে পারি, তাহলে আমাদের জন্য খুবই ভালো হবে।’
ফারুক হাসান বলেন, “ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। এখন থেকে তা বাড়তেই থাকবে বলে মনে হচ্ছে আমার কাছে। প্রায় দেড় শ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনছে।”
বাংলাদেশের নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “কিছুদিন আগে ভারতের দুজন বায়ার আমার কারখানা পরিদর্শনে এসেছিলেন। তারা দুজন আমার পুরোনো ক্রেতা। এবার তারা এসেছেন আরও বেশি অর্ডার দিতে।”
“এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভারতে আমাদের পোশাকের চাহিদা বাড়ছে। আমরা বেশ ভালোভাবেই ভারতের বাজারে প্রবেশ করছি। ভারতের বাজার যদি আমরা মোটামুটি ভালোভাবে ধরতে পারি, তাহলে আর আমাদের পেছনের দিকে ফিরে তাকাতে হবে না।
“কেননা ভারত আমাদের পাশের দেশ, পরিবহন খরচ খুবই কম পড়বে। আমাদের মুনাফা বেশি হবে। ইউরোপ-আমেরিকার বাজারে যদি কখনো কোনো কারণে সমস্যা হয়, তাহলেও আমাদের সমস্যা হবে না,” বলেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
কমেন্ট