এক দশকে রপ্তানি আয় বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি
শুধু ইউরোপ-আমেরিকা নয়, নতুন নতুন বাজারেও পণ্য রপ্তানি করে মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা দেশে আনছেন রপ্তানিকারকরা।
নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও রপ্তানি বাণিজ্যে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। শুধু ইউরোপ-আমেরিকা নয়, নতুন নতুন বাজারেও পণ্য রপ্তানি করে মোটা অঙ্কের বিদেশি মুদ্রা দেশে আনছেন রপ্তানিকারকরা।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৮ লাখ (৫৫.৫৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই পণ্য রপ্তানি থেকে এত বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসেনি। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫২ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন রপ্তানিকারকরা।
দশ বছর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ২ হাজার ৭০২ কোটি ৭৩ লাখ (২৭.০২ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল।
এ হিসবে দেখা যাচ্ছে, এক দশকে রপ্তানি আয় বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আর এই সূচকের উপর ভর করে বাংলাদেশের অর্থনীতিও শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে।
দুই বছরের করোনা মহামারি এবং দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। আর তাতেই বাংলাদেশের অর্থনীতির আকারও বেড়েই চলেছে; প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক ধারাও অব্যাহত রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্য বলছে, দশ বছর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বা অর্থনীতির আকার ছিল ৭ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরের সাময়িক হিসাবে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৭৩ কোটি টাকা।
এই হিসাব বলছে, এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু একবার ছাড়া গত দশ অর্থবছরে প্রতিবারই রপ্তানি আয় বেড়েছে। ২০১২-১৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৭ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। পরের অর্থববছরে (২০১৩-১৪) তা ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে ৩০ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছে।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে আসে ৩১ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫-১৬ তা এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আরও বেড়ে ৩৪ দশমিক ৬৫ বিলিয়নে দাঁড়ায়।
২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে ৩৬ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আরেক লাফে ৪০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে ৪০ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় দেশে আসে।
তবে, পরের অর্থবছরে হোঁচট খায় অর্থনীতির এই সূচক। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় এক ধাক্কায় ৩৩ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
বছর ঘুরতেই ঘুরে দাঁড়ায় রপ্তানি আয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৮ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে।
সবচেয়ে বড় চমক দেখা যায় ২০২১-২২ অর্থবছরে; ওই অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি থেকে আয় ‘৫০ বিলিয়ন ডলার ক্লাব’ অতিক্রম করে। ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় ওই অর্থবছরে; আসে ৫২ দশমিক শূন্য আট বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা।
আর সবশেষ বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে; আয় হয়েছে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার।
১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছে সরকার; প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
৮৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে
ইপিবির তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, এই দশ বছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশের বেশি এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে মোট ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
এই অঙ্ক ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। আর ৪৬ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় হয়েছে দশমিক ৪১ শতাংশ।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছে পোশাক রপ্তানি থেকে। আর এই খাতের উপর ভর করেই রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি থেকে ৪২ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
বিদায়ী অর্থবছরে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে ২৫ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এই খাত থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় হয়েছে দশমিক ৪১ শতাংশ।
অন্যদিকে ওভেন পোশাক রপ্তানি থেকে দেশে এসেছে ২১ দমমিক ২৫ বিলিযন ডলারের বিদেশি মুদ্রা। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্রের চেয়ে বেশি এসেছে দশমিক ৫৪ শতাংশ।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক হচ্ছে বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। আর এই রিজার্ভের প্রধান উৎস হচ্ছে এই রপ্তানি আয়।
পোশাকের ১৮ শতাংশের গন্তব্য এখন নতুন বাজার
২০২২-২৩ অর্থবছরে জাপানে ১৬০ কোটি (১.৬০ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ বেশি।
শুধু জাপান নয়- কেবল রাশিয়া ছাড়া ভারত, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ব্রাজিল, চিলিসহ সব অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রপ্তানির পালে হাওয়া লেগেছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের তৈরি পোশাকের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে যখন রপ্তানি কমছে তখন বিকল্প বাজারে নিয়ে আশার আলো দেখছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।
অপ্রচলিত বা নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি তিন বছর ধরে বাড়ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এই প্রথমবারের মতো নতুন বাজার হিসেবে পরিচিত তিনটি গন্তব্যে পণ্যটির রপ্তানি ১ বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
সব মিলিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানির ১৮ শতাংশের গন্তব্য এখন নতুন বাজার।
বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে ১০০ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। তার আগের অর্থবছরে নতুন বাজারের মধ্যে শুধু জাপানে এক বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ছিল। এই তিনটি দেশই পোশাকের নতুন বাজার হিসেবে পরিচিত।
ইপিবির দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে নতুন বাজারে গেছে ৮ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের পোশাক।
এই রপ্তানি ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। ওই বছরে রপ্তানি হয়েছিল ৬৩৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলারের পোশাক।
তার আগের বছর নতুন বাজারে ৫০৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়।
নতুন বাজারে রপ্তানিতে এই উল্লম্ফনে সন্তোষ প্রকাশ করে পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “এটা আমাদের জন্য খুবই খুশির খবর। আমাদের পোশাকের প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি কমে যাওয়ায় আমরা বেশ বিচলিত। তখন অপ্রচলিত বা নতুন বাজারে রপ্তানি বৃদ্ধিতে আমাদের আশান্বিত করেছে; সাহস জোগাচ্ছে। আশা করছি এই ইতিবাচক ধারা আগামী দিনগুলোতেও অব্যাহত থাকবে।”
তিনি বলেন, “প্রচলিত বাজারগুলোয় যখন বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ দেখলাম, তখন আমরা নতুন বাজারে যাতায়াত বাড়িয়ে দিই। সেসব দেশের প্রদর্শনীতেও অংশ নিতে শুরু করেছেন আমাদের উদ্যোক্তারা।
“বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে অস্ট্রেলিয়াসহ অন্য দেশে সম্মেলন করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। সব মিলিয়ে নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে।”
ফারুক হাসান বলেন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া, চীনসহ অন্য দেশে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিজিএমইএ ২০৩০ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় ১০০ বিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য ঘোষণা করেছে, সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে কী না- এ প্রশ্নের উত্তরে ফারুক হাসান বলেন, “আমাদের প্রধান দুই বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিতে রপ্তানি কমেছে। এই দুই বাজার নিয়ে আমরা চিন্তিত। তবে নতুন বাজার নিয়ে বেশ আশান্বিত।”
“যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে, সরকারের কাছ থেকে গ্যাস-বিদ্যুতসহ অন্যান্য নীতি-সহায়তা পাওয়া যায়, তাহলে অবশ্যই আমরা ১০০ বিলিয়নে পৌঁছতে পারব।”
কমেন্ট