জনশক্তির মতো সৌদির পণ্যের বাজারও দখল করতে চায় বাংলাদেশ

জনশক্তির মতো সৌদির পণ্যের বাজারও দখল করতে চায় বাংলাদেশ

সৌদি আরবের আর্থিক কেন্দ্র রিয়াদ

যে দেশটি থেকে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বাংলাদেশে আসে, সেই দেশ সৌদি আরবে  পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ের চিত্র হতাশাজনক। 

গেলো ২০২২-২৩ অর্থবছরে মধ্যপাচ্যের এই দেশটিতে ২৯ কোটি ৭৫ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে মাত্র ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ বেশি। 

২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাজারে পণ্য রপ্তানি থেকে ২৯ কোটি ডলার আয় হয়েছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরে এই অঙ্ক ছিল ২৬ কোটি ১১ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল একটু বেশি, ২৬ কোটি ২৯ লাখ ডলার। 

এই পরিসংখ্যান বলছে, ভারত, জাপানসহ অন্যান অপ্রচলিত বাজারে (নতুন বাজার) বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আশার আলো দেখালেও সৌদি আরব থেকে রপ্তানি আয় সেই তলানিতেই পড়ে আছে। 

কিন্তু আর নয়; সম্ভাবনাময় এই বাজারও ধরতে চান বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। আর সে লক্ষকে সামনে রেখে বিশাল একটি প্রতিনিধি দল আগামী মাসে সৌদি আরব সফরে যাচ্ছেন। সেই প্রতিনিধি দলে বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা যেমন থাকবেন, তেমনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের প্রতিনিধিরাও থাকবেন। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। আগের অর্থবছরের চেয়ে যা প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। 

জাপানে রপ্তানির অঙ্ক প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার, ১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪০ দশমিক ৪৬ শতাংশ। 

সৌদি আরবে রপ্তানি বাজার ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। অর্থাৎ দেশটি প্রতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে এই বিশাল অংকের অর্থ খরচ করে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করে থাকে। 

এই রপ্তানি বাজারের একটি অংশ দখল করাই বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের সৌদি সফরের প্রধান উদ্দেশ্য বলে জানিয়েছেন ঢাকা চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার সামীর সাত্তার।  

গত মার্চ মাসে সৌদির বাণিজ্য মন্ত্রী ড. মাজেদ বিন আব্দুল্লাহ আল-কাসাবির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসেছিলেন। ঐ সফরে সৌদির বাণিজ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সৌদি সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।   

আল-কাসাবির সফরে বাংলাদেশের সাথে বেশ কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছিল। এই চুক্তিগুলোর মাধ্যমে সৌদি আরব বাংলাদেশের জ্বালানী, সমুদ্রবন্দর ও কৃষি শিল্পের সাথে যুক্ত হবে। একইসাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়াতে দুই দেশের চেম্বারস অফ কমার্স একটি যৌথ কাউন্সিল গঠন করেছিল। 

মূলত ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ব্যারিস্টার সামীর সাত্তারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি দলটি সৌদি আরব সফরে যাবেন।

এ বিষয়ে সামির সাত্তার এআরএইচ ডটকমকে  বলেন, "আমরা সৌদি আরবে সফরের জন্য বর্তমানে একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল তৈরির পরিকল্পনা করছি এবং সেই সংক্রান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছি। ব্যবসায়িক নানা ক্ষেত্র থেকে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জন প্রতিনিধি এই দলে থাকবেন।"   

তিনি বলেন, "আমি মনে করি, আমাদের জন্য ব্যবসার ক্ষেত্রে সৌদি আরব একটি বড় বাজার। সাধারণত আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার দিকেই বেশি জোর দেই। কিন্তু আমরা এলডিসি থেকে উত্তরণ করতে যাচ্ছি। তাই বর্তমানে অন্য অঞ্চলগুলোর দিকেও জোর দেওয়ার সময় এসেছে।" 

২০২১ সালে নভেম্বরে জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী, অর্থনৈতিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যেই বাংলাদেশে এলডিসিভুক্ত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ ঘটাবে। এতে করে এতদিন উন্নত দেশগুলোতে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পেয়ে আসা অনেক সুযোগ বাংলাদেশ আর লাভ করবে না।    

এ বিষয়ে সামির সাত্তার বলেন, "আমাদের রপ্তানির বাজারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের শুধু একটি কিংবা দুটি অঞ্চলে মনোযোগ দিলেই চলবে না।" 

“সৌদিতে যে ব্যবসায়িক প্রতিনিধি দলটি যাবে, সেখানে বিভিন্ন সেক্টরের ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এতে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বড় এন্টারপ্রাইজের ব্যবসায়ীদেরও যুক্ত করা হবে। এছাড়াও ইফাদ গ্রুপ কিংবা ইউনাইটেড গ্রুপের মতো বড় দুই কংগ্লোমারেটকেও প্রতিনিধিদেরও দলে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”   

সামির সাত্তার বলেন, "বড় প্রতিনিধি দলটি নিয়ে আমরা মক্কা, মদিনা ও রিয়াদে যেতে চাই। সৌদি রাষ্ট্রদূত নিজে এবং দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তারাও আমাদের এ সফর নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাসিত। 

এদিকে বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈশা ইউসেফ ঈশা আল-দুহাইলান আরব নিউজ নিউজকে জানান, বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলটি আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই সৌদি আরব সফর করবেন।  

তিনি বলেন, "আমি বাংলদেশের ব্যবসায়ী ও কোম্পানিগুলোকে সৌদি আরব সফরে এসে ব্যবসার সুযোগ লুফে নেওয়ার কথা বলেছি। আমাদের ভিশন ২০৩০ অনুযায়ী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সৌদি আরবের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছি।" 

"সৌদি আরবে ব্যবসার অনেক বড় সুযোগ রয়েছে। এখেন যেকোনো ব্যবসায়িক ক্ষেত্রের কথা শুধু ভাবুন, দেখবেন আপনি সেখানেই বিনিয়োগ করতে পারবেন।" 

ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সৌদি আরবের আমদানি ছিল মোট ১৫২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। দেশটিতে চীন সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে থাকে, যার পরিমাণ ৩১ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলার। এরপরে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ভারত, ও জার্মানি। 

সাতটি সম্ভাবনাময় পণ্য নিয়ে সৌদি আরবের বাজার ধরতে চাইছে বাংলাদেশ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- খাবার ও বেভারেজ, পোশাক, পাট ও চামড়াজাত পণ্য ইত্যাদি। সৌদি আরব এ পণ্যগুলো বর্তমানে বিশ্ববাজার থেকে কিনতে বছরে ৩৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করে। এছাড়া এই বাজারে সিরামিক, ফার্মাসিউটিক্যাল, ও প্লাস্টিক পণ্যেরও ভালো চাহিদা রয়েছে। 

গত বছরের ৬-৮ অক্টোবর রিয়াদে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠেয় 'বাণিজ্য ও বিনিয়োগ মেলা-২০২২'-এ অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধি দল। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি)  কর্মকর্তারাও তাতে অংশ নিয়েছিলেন। 

সৌদির বাজারে বাংলাদেশের এই পণ্যগুলোর ব্যাপক সম্ভাবনা আছে বলে ওই মেলায় অংশ গ্রহণকারী ব্যবসায়ী ও ইপিবি কর্মকর্তারা সরকার তথা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিল। 

পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেশ ভালো

গত ২০২২-২৩ সৌদি আরবে ১৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৯ শতাংশ বেশি। 

২০২১-২২  অর্থবছরে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। 

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, বিদায়ী অর্থবছরে সৌদি আরবে মোট রপ্তানির ৬২ দশমিক ৩২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। 

তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সহ-সভাপতি এআরএইচ ডটকমকে শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, “বেশিরভাগ পোশাক পণ্য চীন, ভারত, তুরস্কসহ অন্যান্য উৎস থেকে কেনে সৌদি আরব। বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক হওয়ার পরও এ বাজারে আমাদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত।” 

তিনি বলেন, সরকারি উদ্যোগের অভাবের কারণে এই বাজারে একটি বিশাল সুযোগ এখনও অব্যবহৃত। এটি অন্যান্য রপ্তানি পণ্য যেমন হোম টেক্সটাইল, কৃষি পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, পাট এবং সিরামিকের জন্যও একটি বড় বাজার হবে।  

“আরবীয় ঐতিহ্যবাহী পোশাকগুলিও উচ্চ মূল্যের পণ্য। সরকারের দিক থেকে যথাযথ উদ্যোগ থাকলে আমরা কমপক্ষে এই বাজারে ৫ থেকে ৬ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব। আর দেরি না করে সবাই মিলে এখন এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে,” বলেন শহীদুল্লাহ আজিম। 

“বিকল্প বাজার হিসেবে এরমধ্যেই আমরা এশিয়ার দেশগুলোতে রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির মুখ দেখছি। আশা করছি সৌদিতেও সফল হবো।”

টানা সাত বার বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান পরবর্তী

টানা সাত বার বিকেএমইএ সভাপতি সেলিম ওসমান

কমেন্ট