রপ্তানি আয়: পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই হতাশা

রপ্তানি আয়: পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই হতাশা

জুলাই-আগস্ট সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক এসেছে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৭৯৯ কোটি ৮৬ লাখ) ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধেও রপ্তানি বাণিজ্যে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৮ লাখ (৫৫.৫৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন দেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। যা ছিল আগের ২০২১-২২ অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি। 

সেই ইতিবাচক ধারা চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) পণ্য রপ্তানি থেকে ৯৩৭ কোটি ৫১ লাখ (৯.৩৭ বিলিয়ন) ডলার বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে। যা গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ বেশি। 

তবে দুঃসংবাদ হচ্ছে, তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানিতে ধস নেমেছে; চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, হিমায়িত মাছ, কৃষিপণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, হোম টেক্সটাইল- সব খাতেই আগের অর্থবছরের চেয়ে আয় বেশ কমেছে।  

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-আগস্ট সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক এসেছে প্রায় ৮ বিলিয়ন (৭৯৯ কোটি ৮৬ লাখ) ডলার। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। 

ইপিবির হিসাব বলছে, জুলাই-আগস্ট দুই মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ দশমিক ৩১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। 

এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ৪ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ। 

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেকই এসেছে নিট পোশাক থেকে। তৈরি পোশাকের ৫৭ দশমিক ২৮ শতাংশ এসেছে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে। 

ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৩ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার; গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৭ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৭ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলার। 

সার্বিক রপ্তানিতে এই দুই মাসে ৯ দশমিক ১২ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা আসলে পোশাক খাতের উপর ভর করেই অর্জিত হয়েছে। 

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও আমরা পোশাক রপ্তানিতে ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছি। এই কঠিন পরিস্থিতিতে সাড়ে ১২  শতাংশ প্রবৃদ্ধি সত্যিই খুশির সংবাদ। প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত বাজারেও (নতুন বাজার) আমাদের পোশাক রপ্তানি বাড়ছে।” 

“তবে আগামী দিনগুলোতে এই ইতিবাচক ধারা থাকবে বলে মনে হয় না। কেননা, বিশ্ব পরিস্থিতি অনুকুলে নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষ্যণ নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তনি কমছে। ইউরোপের দেশগুলোতেও প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। জানি না কী হবে,” বলেন বিজিএমইএ প্রধান।  

“অন্যান্য খাতের রপ্তানির অবস্থা কিন্তু মোটেই ভালো না। আমরা পোশাক রপ্তানিতে হয়ত প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারব। কিন্তু অন্য খাতগুলো সহায়তা না করলে এবার কিন্তু ৬২ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে না।” 

চামড়া খাত  

তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম বড় খাত হচ্ছে চামড়া। ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১৯ কোটি ৪৮ লাখ ২০ হাজার ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছে।

 

এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশ কম। আর নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৪ দশমিক ৩২  শতাংশ। 

২০২৩-২৪ অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট সময়ে এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ২০ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের এই দুই মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ২২ কোটি ৩২ লাখ ৩০ হাজার ডলার।  

পাট খাত

প্রধান রপ্তানি পণ্যের মধ্যে সোনালি আঁশ হিসেবে পরিচিত পাট খাতের অবস্থাও খুব নাজুক। জুলাই-আগস্ট সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ; আয় হয়েছে ১৪ কোটি ৪ লাখ ৬০ হাজার ডলার।  

নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। এই খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ১৫ কোটি ৩৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে আয় হয়েছিল ১৫ কোটি ৬৬ লাখ ১০ হাজার ডলার।

 

হোম টেক্সটাইল  

সবাইকে অবাক করে দিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি বাণিজ্যে একটি ‘নীরব বিপ্লব’ ঘটে। পাট, চামড়া, চিংড়ি ও কৃষিপণ্যকে পেছনে ফেলে পণ্য রপ্তানির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে হোম টেক্সটাইল; ১৬২ কোটি ১৯ লাখ ৩০ হাজার (১.৬২ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে বেশি আসে ৪৩ দশমিক ২৮ শতাংশ।  

সেই আশায় গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ২ বিলিয়ন (১৯৮ কোটি) ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরে সরকার। কিন্তু বড় ধাক্কা খায়। 

গত অর্থবছরের এই খাত থেকে ১০৯ কোটি ৫৩ লাখ ডলার আয় হয়। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩২ দশমিক ৪৭ শতাংশ কম। লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমে আরও বেশি, ৪৪ দশমিক ৬৮  শতাংশ।

 

চলতি অর্থবছরের অবস্থা আরও খারাপ। এই অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে অর্থাৎ জুলাই-আগস্ট সময়ে এই খাত থেকে ১২ কোটি ৫১ লাখ ৪০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫৩ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ৩৩ শতাংশ। 

অন্যান্য খাত

অন্যান্য খাতের মধ্যে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাস জুলাই-আগস্টে হিমায়তি মাছ রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। কৃষি পণ্য থেকে আয় কমেছে ১ শতাংশের মত। 

এক সময়ে আশা জাগানিয়া বাইসাইকেল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৪২ শতাংশ। ফার্নিচার রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৩০ শতাংশ।

 

তবে এই দুই মাসে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় ১৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। 

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৩০ শতাংশ (৫২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন) ডলার তৈরি পোশাক থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। 

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে সব মিলিয়ে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এরমধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে। 

পোশাক রপ্তানির আড়ালে ১০ কোম্পানির ৩০০ কোটি টাকা ‘পাচার’ পরবর্তী

পোশাক রপ্তানির আড়ালে ১০ কোম্পানির ৩০০ কোটি টাকা ‘পাচার’

কমেন্ট