ওষুধ রপ্তানিতে ফের আশার আলো
চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ওষুধ রপ্তানি থেকে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি বাণিজ্যে বেশ আশা জাগিয়েছিল ওষুধ খাত। প্রতিবছরই বাড়ছিল রপ্তানি। বেক্সিমকো, স্কয়ার, ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসসহ প্রথম সারির প্রায় সব কোম্পানিই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১৫৭টি দেশে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ রপ্তানি করছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে ১৮ কোটি ১৮ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের ওষুধ রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেশি। আর সেই সম্বাবনাকে সামনে রেখে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ধরা হয় ২৩ কোটি ডলার।
কিন্তু সে আশা গুড়েবালি। গত অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে ১৭ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করেন ওষুধ রপ্তানিকারকরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ৭ দশমিক শূন্য আট শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ছিল প্রায় ২৪ শতাংশ।
গত অর্থবছরের হতাশা কেটে গেছে; ফের বাড়ছে আয়। সম্ভাবনার ওষুধ রপ্তানিতে আবার আশার আলো দেখা দিয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সবশেষ তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে ওষুধ রপ্তানি থেকে ৫ কোটি ২৬ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় করেছেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৬ শতাংশ বেশি। ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার ডলার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেশি এসেছে ১১ দশমিক ২১ শতাংশ।
গত অর্থবছরের এই তিন মাসে ৪ কোটি ১৮ লাখ ৯০ হাজার ডলার আয় হয়েছিল।
চলতি অর্থবছরে এই খাত থেকে মোট ২১ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরা আছে।
২০২০-২১ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ১৬ কোটি ৯০ লাখ ২০ হাজার ডলার।
দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই গত মার্চ মাসে ঢাকায় ‘বাংলাদেশ ব্যবসা সম্মেলন’নামে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিল, সেই সম্মেলনে ওষুধ রপ্তানি নিয়ে সমূহ সম্ভাবনা ও আশার কথা শুনিয়েছিলেন এ খাতের উদ্যোক্তা ও বিশেষজ্ঞরা।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০-১১ অর্থবছরে ওষুধ রপ্তানি করে মাত্র ৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ।
ধারাবাহিকভাবে বাড়তে বাড়তে ১০ বছরের ব্যবধানে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সেই আয় পাঁচ গুণের বেশি বেড়ে প্রায় ১৯ কোটি ডলারে ওঠে।
কিন্তু সেই ইতিবাচক ধারায় হোঁচট খায় গত অর্থবছরে।
হাডসন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ ঔষধশিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “করোনার ওষুধ রপ্তানি করে ২০২১-২২ অর্থবছরে ভালো আয় করেছিলাম আমরা। বিশ্ববাজারে আমাদের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় এ ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে না। তাই গত অর্থবছরে আয় কিছুটা নিম্নমুখী হয়েছিল। অন্য কোনো কারণে নয়।”
‘এবার ভালো প্রবৃদ্ধি হবে’ এমন আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, “বিভিন্ন দেশে আমাদের ওষুধের চাহিদা বাড়ছে। আগামী দিনগুলোতে আমাদের ওষুধ রপ্তানি থেকে অবশ্যই আরও বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে।”
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, প্রতিবছরই ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে। তবে ২০১৫ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) জন্য ২০৩২ সাল পর্যন্ত ওষুধের মেধাস্বত্বে ছাড় (মেধাস্বত্ব অধিকার-ট্রিপস) দেয়ার পর থেকে এ খাতের রপ্তানির পালে বাড়তি হাওয়া লাগে।
এরপর করোনা চিকিৎসার ওষুধ রপ্তানি করে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় ওষুধ খাত।
করোনাভাইরাস মহামারিতে দেশের বিভিন্ন শিল্প খাত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেও ঔষধশিল্পে তার কোনো প্রভাব পড়েনি। উল্টো করোনা এ খাতে আশীর্বাদই বয়ে এনেছিল বলা যায়।
অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়ছিল সমানতালে। রপ্তানি পণ্যের তালিকায় কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের অন্তর্ভুক্তি, গুণগত মানের উন্নয়ন ও সরকারের নীতি-সহায়তার কারণে সুবাতাস বইছিল এ খাতে।
ঔষধশিল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে কেবল কোভিড-১৯ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রপ্তানি থেকেই আয় হয়েছিল প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা আরও বেড়ে ৫০০ কোটি টাকার মতো দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ মূলত ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, ক্যানসার, কুষ্ঠরোগ, অ্যান্টি-হেপাটিক, পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, কিডনি ডায়ালাইসিস, হোমিওপ্যাথিক, বায়োকেমিক্যাল, আয়ুর্বেদিক ও হাইড্রোসিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওষুধ রপ্তানি করে থাকে।
ঔষধশিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, “আমাদের ঔষধশিল্পের অগ্রগতি এখন গর্ব করার মতো। বাংলাদেশ শুধু নিজেদের ওষুধ নিজেরাই উৎপাদন করে না বরং বিশ্বের শতাধিক দেশে ওষুধ রপ্তানি করে।
“অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা ৭০ শতাংশ ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করতাম। এখন দেশের চাহিদার ৯৮ শতাংশ পূরণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ মানসম্মত ওষুধ রপ্তানি করছে।”
ঔষধশিল্প সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ওষুধ রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশই দখল করে আছে বেক্সিমকো। দ্বিতীয় অবস্থানে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। এ ছাড়া স্কয়ার, এসকেএফ, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালস, একমি ল্যাবরেটরিজসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওষুধ রপ্তানি করে থাকে।
গত মার্চ মাসে এফবিসিসিআই আয়োজিত ব্যবসা সম্মেলনের ওষুধ খাত নিয়ে একটি বিশেষ অধিবেশন হয়। সেখানে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি বাড়ার সম্ভবানা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
ওই অধিবেশনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের ৩০০ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব ও ভুটানসহ বিভিন্ন দেশের মোট আটজন মন্ত্রী অংশ নেন এ সম্মেলনে।
‘বাংলাদেশে ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা: প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক সংযুক্তি ও এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বিনিয়োগের সুযোগ’শীর্ষক ওই অধিবেশনে প্রধান অতিথি ছিলেন বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান। আর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকি আবদুল মুক্তাদির।
অধিবেশনে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, বৈশ্বিক ওষুধের বাজারের ১০ শতাংশ হিস্যার ভাগীদার হওয়ার সম্ভাবনা ও সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের। বর্তমানে ওষুধ উৎপাদনে ভারতকে বলা হয় বিশ্বের ফার্মেসি। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন ওষুধের জন্য ভারতের বাইরে নতুন দেশ অর্থাৎ ভারত প্লাস খুঁজছে। আর এ কারণেই বাংলাদেশ হতে পারে ওষুধ উৎপাদনে বড় ধরনের সম্ভাবনাময় দেশ।
কারণ, বাংলাদেশে আছে সস্তা শ্রম, যা চীন ও ভারত কারোরই নেই। বাংলাদেশে অল্প খরচে উন্নত মানের ওষুধ তৈরি হয়।
বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হয় বিশ্বের ১৫৭টি দেশে। ২৬৫টি নিবন্ধিত ওষুধ কোম্পানির মধ্যে ২১৩টিই উৎপাদনে রয়েছে। দেশের মোট ওষুধ চাহিদার ৯৭ শতাংশ পূরণ হয় দেশে উৎপাদনের মাধ্যমে। বাকি ৩ শতাংশ আমদানি করতে হয়।
ওই অনুষ্ঠানে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের এমডি আবদুল মুক্তাদির বলেন, “ওষুধের বৈশ্বিক বাজার ৪০ হাজার কোটি ডলারের। যদি আমরা বৈশ্বিক বাজার চাহিদার ১ শতাংশও রপ্তানি করতে পারি তবে এ খাত থেকে রপ্তানি আয় আসবে ৪০০ কোটি ডলার।”
“চীনের ওষুধের বাজার ২২ হাজার কোটি ডলারের। আর ভারতের বাজার ৪ হাজার কোটি ডলারের। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এ দুই দেশের পক্ষে বৈশ্বিক চাহিদা মেটানো সহজ নয়।”
প্রধান অতিথির বক্তব্যে নাজমুল হাসান বলেন, “গত কয়েক বছরে চীনে ওষুধ খাতের সঙ্গে জড়িত কর্মীদের বেতন-মজুরি ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। বেতন ও মজুরি বৃদ্ধিতে ভারতও উন্নত দেশগুলোর কাছাকাছি।”
“কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সস্তা শ্রম রয়েছে। তাই সস্তায় উন্নত মানের ওষুধ তৈরির অন্যতম বৈশ্বিক কেন্দ্র হওয়ার সব ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের।”
কমেন্ট