যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি কমেছে ২২%, ভিয়েতনাম চীনের কমেছে আরও বেশি
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। কিন্তু চলতি বছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো কমছে। ফাইল ছবি
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মত আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি থেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। কিন্তু চলতি বছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো কমছে।
এ বছরের প্রথম আট মাসে অর্থাৎ জুলাই থেকে আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানি ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ কমেছে। তবে শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য সব দেশ থেকেও পোশাক আমদানি কমিয়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা। তুলনামূলকভাবে চীন ও ভিয়েতনামের চেয়ে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি পরিস্থিতি ভালো।”
অবশ্য রপ্তানি কমলেও বাংলাদেশি পোশাকের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশ।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীন ও ভিয়েতনামের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এরপর পর্যায়ক্রমে যে সাত দেশ রয়েছে সেগুলো হলো- ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, পাকিস্তান ও কোরিয়া।
গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে এই ১০ দেশেরই পোশাক রপ্তানি কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। তবে সবচেয়ে বেশি কমেছে চীন ও পাকিস্তানের।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২৩ সালের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ৫ হাজার ৩৪৫ কোটি (৫৩.৪৫ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক আমদানি করেন। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২২দশমিক ৭৭ শতাংশ কম।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট সময়ে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৫১৮ কোটি (৫.১৮ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৭৭ শতাংশ কম।
২০২২ সালের এই আট মাসে দেশটিতে ৬৬২ কোটি (৬.৬২ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। ওই সময় প্রতি বর্গমিটার কাপড়ে তৈরি পোশাকের দাম ছিল ২ দশমিক ৯৭ ডলার। চলতি বছর প্রথম আট মাসে তা বেড়ে ৩ দশমিক ২৭ ডলার হয়েছে। তার মানে, পোশাকের দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে চীন। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে চীন ১ হাজার ৯৮ কোটি (১০.৯৮ বিয়িন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তাদের রপ্তানি কমেছে ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট সময়ে চীন রপ্তানি করে ১ হাজার ৫৫৭ কোটি (১৫.৫৭ বিয়িন) ডলারের পোশাক।
ভিয়েতনাম আলোচ্য সময়ে ৯৬৬ কোটি (৯.৬৬ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ কম।
গত বছরের প্রথম আট মাসে ভিয়েতনাম ১ হাজার ২৮০ কোটি (১২.৮০ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে আছে যথাক্রমে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে ভারত ৩২৬ ও ইন্দোনেশিয়া ২৮৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে যুক্তরাষ্ট্রে।
এতে ভারতের রপ্তানি ২১ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং ইন্দোনেশিয়ার ২৬ দশমিক ০৯ শতাংশ কমেছে।
বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বেশ কয়েক মাস ধরেই বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। সে কারণে তারা নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের কেনাকাটা কমিয়ে দিয়েছেন।
এতে পোশাকের ক্রয়াদেশও কমে গেছে। যদিও গত তিন মাস ধরে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ বাড়তে শুরু করেছে—এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছেন দেশের রপ্তানিকারকেরা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাস পাঁচেকের মাথায় জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ শতাংশ অতিক্রম করে, যা দেশটিতে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
তবে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির গতি কমেছে। গত জুলাইয়ে অবশ্য দেশটিতে মূল্যস্ফীতি কমে ৩ দশমিক ২ শতাংশে নেমে এসেছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে (২০২২ সালের জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ কম।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও পোশাক রপ্তানিতে আমরা ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছি। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) ১৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।”
“তবে আগামী দিনগুলোতে এই ইতিবাচক ধারা থাকবে বলে মনে হয় না। কেননা, বিশ্ব পরিস্থিতি অনুকুলে নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তনি কমছে। ইউরোপের দেশগুলোতেও প্রবৃদ্ধি কমে আসছে। জানি না কী হবে।?”
আশার কথা হচ্ছে ভারত, জাপানসহ নতুন বাজারগুলোতে আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। সব বাজারেই বেশ ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।”
“তবে আশা কথা হচ্ছে-আগামী গ্রীষ্মের পোশাকের ক্রয়াদেশ গতবারের চেয়ে কিছুটা ভালো। তার কারণ, ইউরোপ ও আমেরিকায় মূল্যস্ফীতির চাপ খানিকটা কমেছে। অন্যদিকে ব্র্যান্ডগুলোর বিক্রয়কেন্দ্রের পণ্যের মজুতও হ্রাস পেয়েছে। ফলে ইউরোপ ও আমেরিকা উভয় অঞ্চল থেকেই ক্রয়াদেশ আসছে,” বলেন ফারুক হাসান।
নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন থেকেই দেশটিতে পোশাকের চাহিদা কম। এ কারণে ক্রয়াদেশও কম। মূল্যস্ফীতি কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়নি।”
“আগামী বছরের শেষ দিকে দেশটিতে নির্বাচন। তত দিন পর্যন্ত এমন পরিস্থিতি থাকতে পারে বলে আমাদের ক্রেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন।”
অবশ্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকে এখনো সন্তোষজনক বলেই মনে করেন মোহাম্মদ হাতেম।
তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রধান প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনাম। চীনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। তার রেশে ভিয়েতনাম সমস্যায় আছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ বর্তমানে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় নিরাপদ। পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনেও ডাবল সেঞ্চুরি (দুই শতাধিক) হয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আকৃষ্ট হচ্ছে। সে জন্যই চীন ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি পরিস্থিতি ভালো।”
কমেন্ট