সব বাজারেই পোশাক রপ্তানি বাড়ছে, কমছে ভারতে

সব বাজারেই পোশাক রপ্তানি বাড়ছে, কমছে ভারতে

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্যের বাজারেও বাংলাদেশি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে।

একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মত আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি থেকে।

এই বাজারে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ কমেছিল। তবে সুসংবাদ হচ্ছে—পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ। একই সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্যের বাজারেও বাংলাদেশি পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে।

তবে, ভারতে রপ্তানি বেশ কমেছে। গত কয়েক বছর রপ্তানিতে নতুন আশা জাগিয়েছিল পাশের দেশ ভারত। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে পোশাক রপ্তানি থেকে প্রথমবারের মত ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি (১.০১ বিলিয়ন) বিদেশি মুদ্রা দেশে এনেছিলেন রপ্তানিকারকেরা। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪১ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

কিন্তু চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট সময়ে ভারতে পোশাক প্তানি থেকে ২৮ কোটি ২৮ লাখ ডলার আয় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ৩০ কোটি ৬৪ লাখ ডলার।

এ হিসাবে এই তিন মাসে ভারতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ।

তবে বড় বাজারগুলোতে রপ্তানির গতি বেড়ে যাওয়ায় সার্বিকভাবে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সব মিলিয়ে ১ হাজার ১৬২ কোটি (১১.৬২ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩ দশমিক শূন্য সাত শতাংশ বেশি।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বৃহস্পতিবার দেশভিত্তিক রপ্তানি আয়ের যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ইইউতে বাংলাদেশের ৫৫১ কোটি (৫.৫১ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ বেশি। এই বাজারে গত অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

ইইউর বাজারে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় জার্মানি, স্পেন ও ফ্রান্সে। গত অর্থবছর বাংলাদেশি পোশাকের দ্বিতীয় শীর্ষ গন্তব্য জার্মানিতে ৬৬৮ কোটি (৬.৬৮ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। ওই সময় রপ্তানি কমেছিল ৬ দশমিক ৮১ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ১৪৫ কোটি (১.৪৫ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৪১ শতাংশ কম।

এ ছাড়া গত অর্থবছরে ফ্রান্সে ৩৫৮ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল সাড়ে ১৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সেই দেশে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ৬৩ কোটি ডলারের পোশাক।

অন্যদিকে স্পেনে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি একই রকম আছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ১০৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের তুলনায় ২৩ শতাংশ বেশি।

একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশি পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮৫১ কোটি (৮.৫১ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। ওই সময়ে প্রবৃদ্ধি কমেছিল ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাজারটিতে রপ্তানি হয়েছে ২০৭ কোটি (২.০৭ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি।

বাংলাদেশি পোশাকের তৃতীয় শীর্ষ গন্তব্য যুক্তরাজ্যে গত অর্থবছরে ৫০৩ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। তখন প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১১ দশমিক ৭৮ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বরে) রপ্তানি বেড়েছে ২১ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ১৪৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক।

প্রচলিত বাজারের মধ্যে কানাডায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি। যদিও গত ২০২২-২৩ অর্থবছর এই বাজারে রপ্তানি হয়েছিল ১৫৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। ওই সময় প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নতুন বাজারে ভালো করছে। যদিও গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে নতুন বাজারে ৮৩৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। তখন প্রবৃদ্ধি ছিল ৩১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রবৃদ্ধি কমে ২৪ দশমিক ৯৩ শতাংশে নেমেছে। এই সময়ে রপ্তানি হয়েছে ২২৪ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১৭৯ কোটি ডলার।

চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে নতুন বাজারের মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। তবে ভারতে রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ব্রাজিলসহ অন্যান্য দেশেও তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে।

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যেও পোশাক রপ্তানিতে আমরা ইতিবাচক ধারা ধরে রেখেছি। গত অর্থবছরে ১০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ১৩ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।”

তিনি বলেন, “বড় বাজারের পাশাপাশি নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি খুবই ইতিবাচক। দুই মাস ধরে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে ক্রয়াদেশ কিছুটা বেড়েছে। মূলত যেসব ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের পণ্যের মজুত কমছে, তারাই ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। তারপরও গত বছরের তুলনায় এখনো ক্রয়াদেশ কম। যদিও প্রতিযোগী দেশগুলোতে পোশাকের ক্রয়াদেশ আমাদের চেয়েও কম।”

ফারুক হাসান বলেন, “বিশ্বজুড়ে পোশাকের চাহিদা চলতি বছর কম থাকবে। তারপরও আমাদের রপ্তানি ইতিবাচক ধারায় থাকবে বলে আশা করছি আমরা।”

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন থেকেই দেশটিতে পোশাকের চাহিদা কম। এ কারণে ক্রয়াদেশও কম। মূল্যস্ফীতি কমলেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়ায়নি।”

“এর মধ্যেও প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসা খুবই ইতিবাচক বলে আমি মনে করি।”

প্রতিযোগী দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকে সন্তোষজনক বলেই মনে করেন মোহাম্মদ হাতেম।

“যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের প্রধান প্রতিযোগী চীন ও ভিয়েতনাম। চীনের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। তার রেশে ভিয়েতনাম সমস্যায় আছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ বর্তমানে প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় নিরাপদ। পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনেও ডাবল সেঞ্চুরি (দুই শতাধিক) হয়েছে। এসব কারণে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্সহ অন্য সব দেশের ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আকৃষ্ট হচ্ছে। সে জন্যই চীন ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি পরিস্থিতি ভালো।”

রপ্তানি আয়: ২০৪১ সালে ৩০০ বিলিয়নের লক্ষ্য পরবর্তী

রপ্তানি আয়: ২০৪১ সালে ৩০০ বিলিয়নের লক্ষ্য

কমেন্ট