সনদ পেল খুলনার সুপারেক্স, খবর নেই সাভারের ১৪২ ট্যানারির

সনদ পেল খুলনার সুপারেক্স, খবর নেই সাভারের ১৪২ ট্যানারির

নতুন সনদ পাওয়া ট্যানারি সুপারেক্স লেদার লিমিটেড। কারখানাটি খুলনার ফুলতলার উত্তরডিহিতে অবস্থিত। ফাইল ছবি

দেশের চামড়া শিল্প খাতের জন্য সুখবর। আরও একটি চামড়া কারখানা বা ট্যানারি আন্তর্জাতিক লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ পেয়েছে। নতুন সনদ পাওয়া ট্যানারির নাম সুপারেক্স লেদার লিমিটেড।

এটি খুলনার ফুলতলার উত্তরডিহিতে অবস্থিত। গত মাসে সুপারেক্স লেদারকে সিলভার শ্রেণিতে এলডব্লিউজি সনদ দেওয়া হয়। এই কারখানার দৈনিক ৮০ হাজার বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাতের সক্ষমতা রয়েছে।

এ নিয়ে দেশে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা বেড়ে চারটি হলো। এগুলো হলো— অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার, রিফ লেদার, এবিসি লেদার ও সুপারেক্স লেদার। তবে সব কটি কারখানা সাভারে অবস্থিত চামড়াশিল্প নগরীর বাইরে অবস্থিত। চামড়াশিল্প নগরীতে বর্তমানে ১৪২টি ট্যানারি রয়েছে।

বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজি সনদ থাকতে হয়। ফলে বাংলাদেশ মূলত এমন বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে, যেখানে ব্র্যান্ড মূল্য নেই। ফলে এ দেশের রপ্তানিকারকেরা পণ্যের দাম কম পান।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৫০ কোটি ডলার আয় হারাচ্ছে।

মূলত মানসম্মত কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) না থাকা ও পরিবেশদূষণের কারণে সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর কোনো ট্যানারি এখন পর্যন্ত এলডব্লিউজি সনদ পায়নি। ইউরোপের বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডগুলো এই সনদধারী প্রতিষ্ঠানের বাইরে অন্য কারখানা থেকে চামড়া বা চামড়াজাত পণ্য কেনে না।

এ কারণে বড় বড় ক্রেতা ও ব্র্যান্ডের কাছে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি সনদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। 

বৈশ্বিক বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফরচুন বিজনেস ইনসাইটসের তথ্যানুযায়ী, গত বছর চামড়াপণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৬ হাজার কোটি ডলারের। কিন্তু চামড়াজাত পণ্যের এত বিশাল বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা খুবই সামান্য।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২১-২২ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১২৪ কোটি ৫২ লাখ (১.২৪ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২০-২১) চেয়ে ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ বেশি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় এসেছিল প্রায় ২১ শতাংশ।

গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই খাত থেকে ১২২ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে আসে। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ২ শতাংশ কম।

চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে মাত্র ৩২ কোটি ৫৫ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ।

এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের চেয়ে ২৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ২২ দশমিক ২৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমাদের দুর্ভাগ্য যে এতো দিনেও আমরা সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে একটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ করতে পারলাম না। অনেক বলেছি; এটা নিয়ে আর কথা বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই—যদি আমরা এই সিইটিপি ভালোভাবে করতে পারি, তাহলে আমাদের চামড়া খাত থেকে রপ্তানি আয় তিন-চার বছরের মধ্যে ৫ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।”

এলডব্লিউজি কী

২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস ও টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষায় জোর দিয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য।

বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য।

এলডব্লিউজির ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটি কারখানা নিরীক্ষার জন্য একটি সাধারণ মানকাঠামো তৈরি করেছে। এ ক্ষেত্রে তারা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর উপাদান, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস ইত্যাদি বিষয় খতিয়ে দেখে।

দেশে ২০১৫ সালে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ট্যানারি ইউনিট প্রথম এলডব্লিউজি সনদ পায়। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ট্যানারিটি অবস্থিত। ২০২০ সালের শুরুর দিকে এলডব্লিউজি সনদ পায় চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত রিফ লেদার।

২০২১ সালের শেষের দিকে আশুলিয়ার জিরাবোতে অবস্থিত আরেক প্রতিষ্ঠান এবিসি লেদার এলডব্লিউজি সনদ পায়। সর্বশেষ সনদ পেয়েছে সুপারেক্স লেদার।

এই চারটি ট্যানারির মধ্যে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার নিরীক্ষায় সেরা মান অর্থাৎ গোল্ড শ্রেণির কারখানার মর্যাদা পেয়েছে। এ ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়েছে সিলভার শ্রেণির মর্যাদা।

প্রতিষ্ঠার ৭ বছরেই এলডব্লিউজি

২০১৬ সালে খুলনার ফুলতলা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম উত্তরডিহিতে সুপারেক্স লেদারের যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাতা এম ফিরোজ আহমেদ শুরু থেকেই একটি পরিবেশবান্ধব ট্যানারি তৈরির পথে হাঁটেন। বিনিয়োগ করেন প্রায় ৭০০ কোটি টাকা।

সুপারেক্সের দৈনিক ৮০ হাজার বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাতের সক্ষমতা রয়েছে। এ ট্যানারিতে এক একর জায়গাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বা ইটিপি। এ ছাড়া ৫ লাখ চামড়া সংরক্ষণের একটি হিমাগারও রয়েছে।

সুপারেক্স লেদারের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফিরোজ আহমেদ জানান, এলডব্লিউজি সনদ পেতে দুই বছর ধরে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেছেন তারা। সর্বশেষ গত আগস্টে এলডব্লিউজি নিরীক্ষার জন্য আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি। নিরীক্ষা শেষে চূড়ান্তভাবে সনদ দেওয়া হয়।

বর্তমানে প্রতি মাসে দু-তিন লাখ বর্গফুট চামড়া রপ্তানি করে সুপারেক্স। এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ায় চামড়া রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ লাখ বর্গফুটে পৌঁছাবে বলে আশা প্রতিষ্ঠানটির।

পিছিয়ে চামড়াশিল্প নগরীর ট্যানারি

ব্যক্তি উদ্যোগে দেশের চার কারখানা এলডব্লিউজি সনদ পেলেও সাভারের চামড়াশিল্প নগরীর ট্যানারিগুলো পিছিয়ে রয়েছে। এর কারণ চামড়াশিল্প নগরীকে পরিবেশবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে পারেনি সরকার।

রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নিতে হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্প শেষ করতে ২১ বছর সময় নেয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। শিল্পনগরীর সিইটিপি শুরু থেকেই অপ্রতুল অবস্থায় রয়েছে। কঠিন বর্জ্য ফেলার স্থায়ী ব্যবস্থাও নেই সেখানে।

চামড়াশিল্প নগরীতে বর্তমানে সচল ট্যানারির সংখ্যা ১৪২। ট্যানারির মালিকেরা জানিয়েছেন, ১২-১৫টি ট্যানারির এলডব্লিউজি সনদ পাওয়ার যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু সিইটিপির দুর্বলতার কারণে সেগুলো এলডব্লিউজির আবেদন করতে পারছে না। কয়েক বছর ধরে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিক সিইটিপির সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে এলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন নেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, “চামড়াশিল্প নগরে সিইটিপির দুর্বলতার কারণে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। এ কারণে ট্যানারিগুলো এলডব্লিউজি সনদের জন্য আবেদন করতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রী চামড়া উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন। আশা করছি, দ্রুততম সময়ে এটি বাস্তবায়িত হলে চামড়াশিল্প খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।”

সাভার চামড়াশিল্প নগরী কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা বলে আসছেন ট্যানারির মালিকেরা। তারা চাইছেন বিসিকের পরিবর্তে অন্য কোনো সংস্থার অধীনে চামড়াশিল্প নগরীর দায়িত্ব দেওয়া হোক। ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে চামড়াশিল্প উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গঠনের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।

গবেষণা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‌্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ বলেন, “বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শর্ত পূরণের ক্ষেত্রেই আমাদের সাভারে অবস্থিত ট্যানারিগুলো পিছিয়ে যাচ্ছে। এলডব্লিউজি সনদ পেতে ট্যানারি ও সরকারি কর্তৃপক্ষকে সমান্তরালভাবে কাজ করতে হবে। এ জন্য দ্রুততম সময়ে সিইটিপি সংস্কারের পাশাপাশি ট্যানারিগুলোকেও প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।”

ক্রেতাদের কাছে চিঠি, পোশাকের বেশি মূল্য চায় বিজিএমইএ পরবর্তী

ক্রেতাদের কাছে চিঠি, পোশাকের বেশি মূল্য চায় বিজিএমইএ

কমেন্ট

এই সংক্রান্ত আরও খবর