বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা উড়িয়ে দিলেন বাণিজ্য সচিব ও রপ্তানিকারকরা
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে সব দেশে শ্রম পরিস্থিতি আরও উন্নত হোক। এটা শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করে না।”
শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতির কারণে বাংলাদেশে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ও পোশাক রপ্তানিকারকরা।
শ্রম পরিস্থিতির ধারাবাহিক উন্নতির জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ আলোচনার ভিত্তিতে সংস্কার প্রক্রিয়া চলমান আছে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, “আমাদের কাজে তারা সন্তুষ্ট।”
সোমবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, পোশাক শিল্পমালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতা, শ্রম সচিব, বেপজার নির্বাহী চেয়ারম্যানকে নিয়ে বৈঠক করেন বাণিজ্য সচিব।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি নেই। যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে সব দেশে শ্রম পরিস্থিতি আরও উন্নত হোক। এটা শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করে না।”
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী শ্রম অধিকার সুরক্ষায় গত মাসে নতুন এক ঘোষণায় সই করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বে যারা শ্রমিক অধিকার হরণ করবে, শ্রমিকদের ভয়ভীতি দেখাবে এবং আক্রমণ করবে, তাদের উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার ঘোষণা রয়েছে।
ওই মেমোরেন্ডামের ঘোষণা দেওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অন্টোনি ব্লিঙ্কেন শ্রমিক নির্যাতনের উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশের শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তারের নাম উল্লেখ করেন। এরপর বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই নীতির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে বলে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর সেলিম রেজা এক দাপ্তরিক চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করেছেন।
ওই চিঠি হাতে পাওয়ার পর এই বৈঠকে বসলেও একে ‘নিয়মিত বৈঠক’ আখ্যা দিয়ে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি বলেন, “আমরা শ্রমিক অধিকার প্রশ্নে ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য বসেছিলাম।”
“তবে সেটা (যুক্তরাষ্ট্রের নীতি) আমরা বিবেচনায় নিয়েছি। পাঁচজন অ্যাম্বাসেডর ও তিনজন সচিব মিলে যে ‘থ্রি প্লাস ফাইভ’ একটা আলোচনা হয় সেই আলোচনাটা চলতি মাসেই হওয়ার কথা আছে। সেই আলোচনার আগে আমরা ব্যবসায়ী ও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বসে আলাপ করে নিলাম।”
“যুক্তরাষ্ট্রের মেমোরেন্ডামটা নিয়েও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমরা আলাপ করেছি। স্টেকহোল্ডারদের বলেছি যে, সামনের দিকে আর কী কাজ করা যায়।”
বাণিজ্যসচিব বলেন, “আমরা প্রায় ২০০ দেশে পণ্য রপ্তানি করি। তার মধ্যে কয়েকটি দেশে খুব বেশি করি, কিন্তু ২০০ দেশে রপ্তানি করি। সুতরাং আমাদের লক্ষ্য থাকবে কীভাবে প্রতিযোগিতা মূল্যে কমপ্লায়েন্স অর্জন করে এবং ক্রেতার রিকয়্যারমেন্ট পূরণ করেই কিন্তু রপ্তানি করতে হয়।
“আমরা কারও দয়াদাক্ষিণ্যে রপ্তানি করি না। আমাদের শ্রমিক, উদ্যোক্তরা অনেক পরিশ্রম করেন। সব নিয়ম মেনে কোয়ালিটি পণ্য আমরা কম দামে দিতে পারি বলেই রপ্তানি হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “আমাদের রপ্তানি বাজার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য যা যা করণীয় তা আমরা করব আমাদের স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে। আমাদের অর্থনীতির সক্ষমতা, রপ্তানি পরিস্থিতি সবকিছু দেখে এবং আন্তর্জাতিক যে রিকয়্যারমেন্ট আমাদের মানতে হবে, সেটা মেনেই আমরা করব।”
তপন কান্তি ঘোষ বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নে আমরা ২৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করি, সেটা শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায়। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করি, কিন্তু সেখানে কোনো শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া যায় না। অনেক বেশি শুল্ক দিয়ে বাংলাদেশকে রপ্তানি করতে হয়।”
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নিয়ে রপ্তানিকারকরা সচেতন
বাণিজ্য সচিব বলেন, “ইউএসএর প্রেসিডেন্সিয়াল ম্যামোরেন্ডাম বিষয়ে রপ্তানিকারকরা সচেতন আছেন। আমরাও অবশ্যই সচেতন আছি।
“আমাদের রপ্তানি বাজার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য যা যা করা দরকার আমরা সেটা করব। তবে অর্থনৈতিক সক্ষমতা, রপ্তানি পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর চাহিদা বিবেচনায় রেখেই সামনে আগাতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গত ২০ সেপ্টেম্বর আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা আমাদের অগ্রগতিগুলো সম্পর্কে জানে। তারা চায় যে আরও অগ্রগতি হোক। কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো উন্নত না।”
সংস্কার প্রক্রিয়ার উদাহরণ দিয়ে তপন কান্তি বলেন, “২০১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনবার শ্রম আইনে সংস্কার আনা হয়েছে। চারবার মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে মজুরি সংস্কার করা হয়েছে। নতুন নতুন শিল্পায়ন হচ্ছে, সেখানে কর্মপরিবেশ, শ্রম অধিকার এগুলো নিশ্চিতের ক্ষেত্রে একটা ভালো অবস্থানে আমরা আছি।”
সামনের দিকে সংস্কার করার মতো সমস্যা কোথায় রয়েছে প্রশ্ন করলে সচিব বলেন, “এখন ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে কারখানার ২০ ভাগ শ্রমিকের সমর্থন প্রয়োজন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি ছিল আইএলও কনভেনশন অনুযায়ী এটাকে ১০ ভাগে নামিয়ে আনতে হবে। আমরা সেটাকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছি।”
বেপজা আইন অনুযায়ী এখন ট্রেড ইউনিয়ন না বলে আমরা ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন বলে থাকি। সেখানে তারা ট্রেড ইউনিয়ন প্রবর্তনের কথা বলে। জিনিসটা প্রায় একই।”
২০২৫ সালের জুনের মধ্যে বেপজা আইনটা সংশোধন হবে জানিয়ে তপন কান্তি বলেন, “সংশোধন করে কী করা হবে সেটা আমরা স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে ঠিক করতে চাচ্ছি।”
এই স্টেক হোল্ডার বলতে তিনি বুঝিয়েছেন বিনিয়োগকারী, মালিকপক্ষ, শ্রমিক ও সরকার।
সচিব বলেন, “আগে বেপজার কারখানাগুলোতে সরকারি পরিদর্শকরা পরিদর্শন করতে পারত না। এখন বিদেশিদের দাবির প্রেক্ষিতে আমরা সেটা চালু করেছি। ইতোমধ্যেই ৬৩টি কারখানায় পরিদর্শন সম্পন্ন হয়েছে।”
উদ্বেগ নেই বিজিএমইএরও
বৈঠকে উপস্থিত তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক ও উৎপাদকদের সমিতি—বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নিয়ে আমরা মোটেও উদ্বিগ্ন নই। কারণ, আমরা মনে করি, আমাদের যে সংস্কারমূলক কাজগুলো চলছে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিবিরুদ্ধ কিছু নেই। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লানের কাজ চলছে। সেই কাজগুলো যেন চলমান থাকে সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি।”
একই ধরনের বক্তব্য রাখেন পোশাক ব্যবসায়ীদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও। তিনি বলেন, “শ্রম অধিকার নিয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন আছি। শ্রম পরিস্থিতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে এমনটি আমি মনে করি না।”
কী আছে বাইডেনের মেমোরেন্ডামে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, শ্রম অধিকার ও শ্রমিকদের মানসম্মত জীবনযাপন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রেসিডেনশিয়াল মেমোরেন্ডাম সই করার পর গত ১৬ নভেম্বর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন তা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে বলেছেন, যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিরুদ্ধে যাবেন, শ্রমিকদের হুমকি দেবেন কিংবা ভয় দেখাবেন, তাদের ওপর প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।
শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতির বিষয়ে জানাতে গিয়ে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের পোশাক খাতের শ্রমিক আন্দোলনের নেতা কল্পনা আক্তারের নামটিও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কল্পনা জানিয়েছেন, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস তার পক্ষে দাঁড়িয়েছে এবং এ জন্য তিনি (কল্পনা) এখনো বেঁচে আছেন।
এ বিষয়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাস ঢাকায় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সতর্ক করে বলেছে, বিশ্বব্যাপী শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যে স্মারকটি ঘোষণা করেছেন, বাংলাদেশ তার লক্ষ্যবস্তু হতে পারে এবং শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে এই নীতি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের ওপর আরোপের সুযোগ রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) সেলিম রেজার লেখা চিঠিটি বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের কাছে পাঠানো হয় ২০ নভেম্বর। ওই চিঠির সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্টের ‘বিশ্বব্যাপী শ্রমিক ক্ষমতায়ন, অধিকার ও উচ্চ শ্রমমান এগিয়ে নিতে স্মারক’ সংক্রান্ত একটি সংকলিত প্রতিবেদন পাঠানো হয়।
এর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এর আগে গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য একটি ভিসা নীতি ঘোষণা করে। ওই নীতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বাংলাদেশিদের ভিসা দেবে না।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন বলে জানানো হয়।
একক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।
কমেন্ট