ভারতে রপ্তানি কমছে, বাড়ছে জাপান চীন রাশিয়ায়
চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ভারতের বাজারে ৮২ কোটি ৬৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাশের দেশ ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।
যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানি থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়নি।
এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতেই, ১১ জুলাই থেকে শুরু হয় বহুল প্রতিক্ষিত এই লেনদেন।
সবাই আশা করেছিলেন ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হলে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশটিতে রপ্তানি আয় আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু তা না বেড়ে উল্টো কমছে।
তবে অন্য অপ্রচলিত (নতুন) বাজারে আশার আলো দেখাচ্ছে। জাপান, চীন, অষ্ট্রেলিয়া ও তুরস্কে পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেশ বেড়েছে। এমনকি যুদ্ধের কারণে নানা বাধার মধ্যেও রাশিয়ায় রপ্তানি বাড়ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বুধবার রপ্তানি আয়ের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে অর্থাৎ জুলাই-নভেম্বর সময়ে ভারতের বাজারে ৮২ কোটি ৬৪ লাখ ২০ হাজার ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই পাঁচ মাসে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে প্রায় ১ বিলিয়ন (৯৬ কোটি ৭৯ লাখ) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে প্রায় ৮ শতাংশ বেশী।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ভারতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৩৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ ডলার।
এ হিসাবে এই পাঁচ মাসে ভারতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৭ দশমিক ১ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল।
গত কয়েক বছর ধরেই ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। পাঁচ বছরের মাথায় গত অর্থবছরে সেই আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে মাত্র চারটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়েছে, তাও সেটা গত চার বছরে। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। যদিও সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
২০১১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামিদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সে কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়ায়। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবকাঠামোগত যোগাযোগের উন্নতিও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
“সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে রপ্তানি কমছে। তবে শুধু ভারত নয়, অন্য দেশগুলোতেও রপ্তানি কমছে।”
তিনি বলেন, “ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে নির্ধারিত মান পরিপালনের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গবেষক আরও বলেন, “গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বর্তমানে কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়বে।
“একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে।”
“রুপিতে বাণিজ্য শুরু হওয়ার কারণে ভারতে রপ্তানি বাড়ার কথা। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো কমছে;এর কারণ সরকার ও রপ্তানিকারকদের খুঁজে বের করতে হবে।”
একই কথা বলেছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান। তিনি বলেন, “আমরা প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত (নতুন) বাজারেও রপ্তানি বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছি। তারই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছিল। ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য অপ্রচলিত বাজারেও আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল।”
তিনি বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আমাদের প্রধান দুই বাজার আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা পোশাক রপ্তানিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। ওই দেশগুলোর মানুষ এখন পোশাক কেনা কমিয়ে দিচ্ছেন। সে অবস্থায় ভারতসহ অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়ায় আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম।”
“চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ভারতে আমাদের রপ্তানি কমছে। কেনো কমেছে-আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। সরকারকেও বিষয়টিকে নজর দিতে হবে।”
ফারুক হাসান বলেন, “ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছিল। প্রায় দেড়শ’কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনবে।”
“আমাদের এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। কোথায় দুর্বলতা আছে; কী করতে হবে-তা দ্রুত করতে হবে,” বলেন ফারুক হাসান।
তৈরি পোশাক ছাড়া ভারতে অন্য যে সব পণ্য রপ্তানি হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—পাট ও পাটজাতপণ্য, কটন ও কটন প্রোডাক্টস, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ভারতে ৯ কোটি ৬০ লাখ ১০ হাজার ডলারের পাট ও পাটজাতপণ্য, ১ কোটি ৩৫ লাখ ৬০ হাজার ডলারের কটন ও কটন প্রোডাক্টস, ১ কোটি ৫২ লাখ ১০ হাজার ডলারের প্লাস্টিক দ্রব্যাদি এবং ৫ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে।
অন্য অপ্রচলিত বাজারে বাড়ছে
ভারতে রপ্তানি কমলেও এই পাঁচ মাসে জাপান, চীন, অষ্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও তুরস্কসহ অন্য অপ্রচলিত বাজারে বেড়েছে। পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেশ বেড়েছে।
জুলাই-নভেম্বর সময়ে জাপানে প্রায় ৮০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ বেশি। চীনে রপ্তানি হয়েছে ৩৫ কোটি ডলারের পণ্য; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
রাশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে ১৮ কোটি ৬৫ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পণ্য; বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
এছাড়া এই পাঁচ মাসে অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ। তুরস্কে বেড়েছে ৩৯ শতাংশ।
বড় বাজারের প্রায় সব দেশেই কমেছে
একক দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির সবচেয়ে বড় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; জুলাই-নভেম্বর সময়ে এই বাজারে রপ্তানি আয় কমেছে ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। জার্মানিতে কমেছে ১৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। কানাডায় কমেছে ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ।
তবে যুক্তরাজ্যে ১৪ শতাংশ ও স্পেনে ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ বেড়েছে।
কমেন্ট