উৎকণ্ঠার মধ্যেও রপ্তানিতে রেকর্ড, এক মাসেই এল পৌনে ৬ বিলিয়ন ডলার
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস রপ্তানি আয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৫৭২ কোটি ৪৩ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা। একক মাসের হিসাবে এই আয় অতীতের যে কোনো মাসের চেয়ে বেশি।
এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৩৬ কোটি ৫২ লাখ (৬.৩৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল একক মাসের হিসাবে সর্বোচ্চ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ৫৩০ কোটি ৮১ লাখ (৫.৩১ বিলিয়ন) ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রবিবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়,জানুয়ারি মাসে গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ১১ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫১৩ কোটি ৬২ লাখ (৫.১৩ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিলেন রপ্তানিকারকরা।
সংকটের সময় রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে তা কেটে যাবে।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ হাজার ৩২৬ কোটি ৪৭ লাখ (৩৩.২৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সাত মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩২ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি করে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ছিল ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
অক্টোবরের রপ্তানি আয় ছিল ২৬ মাস পর সবচেয়ে কম। ২০২১ সালের আগস্টে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিলেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।
তবে পরের মাস নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেশ খানিকটা বাড়ে; আসে ৪৭৮ কোটি ৪৮ লাখ (৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েক দিন বেশ কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ থাকার পরও নভেম্বরে অক্টোবরের চেয়ে বেশি আয় দেশে এসেছিল।
ডিসেম্বর মাসে এক লাফে বেড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়; আসে ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা। সবশেষ জানুয়ারিতে এসেছে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে চার মাসে কেবল ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল। এর মধ্যে ২০২২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আসে যথাক্রমে ৫ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ও ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এসেছিল ৫ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।
সদ্য শেষ হওয়া জানুয়ারি মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। এতে দেখা যাচ্ছে—জানুয়ারি মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সমান রপ্তানি আয় দেশে এসেছে।
চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে (জুলাই–অক্টোবর) পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে টানা তিন মাস (অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধি কমায় সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির গতি কমে দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
জানুয়ারিতে বাড়ায় প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।
৮৫.২৬ শতাংশই এসেছে পোশাক থেকে
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুলাই-জানুয়ারি সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প থেকে এসেছে ২৮ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ১৬ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার; গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ২ দশমিক ২০ শতাংশ।
এই সাত মাসে পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৩০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ২৭ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির হিসাব বলছে, জুলাই-জানুয়ারি—এই সাত মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ দশমিক ২৬ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
জানুয়ারিতে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২.৪৫%
মূলত পোশাক রপ্তানিতে আয় বাড়ার কারণেই জানুয়ারি মাসে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে রেকর্ড হয়েছে। এই মাসে পোশাক রপ্তানি থেকে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৪.৯৭ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি।
আগের মাস ডিসেম্বরে পোশাক রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে পোশাক রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিলেন এ খাতের রপ্তানিকারকরা।
জানুয়ারিতে ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের জানুয়ারিতে এসেছিল ২ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার। বেড়েছে ৭ দশমিক ১৬ শতাংশ।
এই মাসে নিট পোশাক থেকে এসেছে ২ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে এসেছিল ২ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “নানা বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু আমরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা এখনও লেগে আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আমাদের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাবারের পেছনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে।”
“এরই মধ্যে জানুয়ারিতে পৌনে ৬ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আমাদের আশান্বিত করেছে। প্রতি বছরই ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে রপ্তানি আয় বাড়ে। এবারও তার ব্যতয় হয়নি। তবে আগামী দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে কী না—চিন্তায় আছি আমরা।”
“আমরা প্রতাশা করবো এই ইতিবাচক ধারা যেনো অব্যাহত থাকে। আর সেটা যদি থাকে, তাহলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে, তা কেটে যাবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গবেষক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীত ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এই সংকটের সময় এক মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় খুবই স্বস্তির খবর। এই আয় রিজার্ভের পতন ঠেতাতে সহায়তা করবে।”
তবে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে এই ইতিবাচক ধারা যাতে আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকে সেটার দিকে রপ্তানিকারক ও সরকারকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
“মনে রাখতে হবে—এই মুহূর্তে রপ্তানি আয় যদি কমে যেতো, তাহলে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু আরও কমে যেত। তাতে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়ত। তাই আমি মনে করি, রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স যেনো বাড়ে, সেদিকেই সবার সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিৎ।”
অন্যান্য খাত
তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি আয় কমেছে। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) হিমায়তি মাছ রপ্তানি কমেছে ১৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ৩৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
তবে এই সাত মাসে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় ১০ শতাংশ বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ১৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৩০ শতাংশ (৫২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন) তৈরি পোশাক থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে সব মিলিয়ে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে।
কমেন্ট