ভারতে রপ্তানিতে ধস, চীন ও রাশিয়ায় আশার আলো
বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য বেশি হয়ে থাকে। ফাইল ছবি
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাশের দেশ ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা। যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই ভারতের বাজারে পণ্য রপ্তানি থেকে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় হয়নি।
এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতেই, ১১ জুলাই থেকে শুরু হয় বহুল প্রতিক্ষিত এই লেনদেন।
সবাই আশা করেছিলেন ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য শুরু হলে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশটিতে রপ্তানি আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু তা না বেড়ে উল্টো কমছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনে রপ্তানি বাড়ছে। অপর দুই অপ্রচলিত বাজার জাপান ও রাশিয়াতেও বাড়ছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বুধবার রপ্তানি আয়ের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে অর্থাৎ জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ভারতের বাজারে ১১৩ কোটি (১.১৩ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৩৪ কোটি ৫৮ লাখ (১.৩৪ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই সাত মাসে আয় হয়েছিল ১২১ কোটি ২৪ লাখ (১.২১ বিলিয়ন) ডলার।
পোশাক রপ্তানি কমেছে ২২ শতাংশ
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ভারতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৫১ কোটি ৮৬ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৬৬ কোটি ৬ লাখ ডলার।
এ হিসাবে এই সাত মাসে ভারতে পোশাক রপ্তানি কমেছে ২১ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
২০২১-২২ অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল।
গত কয়েক বছর ধরেই ভারতে রপ্তানি বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। পাঁচ বছরের মাথায় গত অর্থবছরে সেই আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে মাত্র চারটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়েছে, তাও সেটা গত চার বছরে। তার আগের বছরগুলোয় ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ১ বিলিয়ন ডলারের নিচে।
২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬১ লাখ ৬০ হাজার ডলারে নেমে আসে।
২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। যদিও সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিলেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
২০১১ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়ে।
কিন্তু গত কয়েক বছরে ভারতের বিভিন্ন শহরে পোশাকের নামিদামি বিদেশি অনেক ব্র্যান্ড বিক্রয়কেন্দ্র খোলায় তাতে পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পায়।
গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সে কারণে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই কাছাকাছি উৎস থেকে পণ্য সংগ্রহের দিকে মনোযোগ বাড়ায়। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবকাঠামোগত যোগাযোগের উন্নতিও এ ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে।
“সব মিলিয়ে গত অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে। তার আগের বছরেও প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আসে। কিন্তু চলতি অর্থবছরে সেই ইতিবাচক ধারা আর নেই।”
তিনি বলেন, “ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তবে ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।”
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এ গবেষক আরও বলেন, “গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ কমপ্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (সেপা) স্বাক্ষর নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশ যথাযথ নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে এ চুক্তি করলে ভারতে রপ্তানি বাড়বে।
“একই সঙ্গে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতের বিনিয়োগকারীদের উৎপাদিত পণ্য তাদের দেশে এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশে রপ্তানি হবে।”
“রুপিতে বাণিজ্য শুরু হওয়ার কারণে ভারতে রপ্তানি বাড়ার কথা। কিন্তু সেটা না হয়ে উল্টো কমছে;এর কারণ সরকার ও রপ্তানিকারকদের খুঁজে বের করতে হবে।”
একই কথা বলেছেন দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “বেশ কিছুদিন ধরে আমরা প্রচলিত বাজারের পাশাপাশি অপ্রচলিত (নতুন) বাজারেও রপ্তানি বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছি। তারই ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছিল। ভারতের পাশাপাশি অন্যান্য অপ্রচলিত বাজারেও আমাদের রপ্তানি বাড়ছিল।”
“রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় আমাদের প্রধান দুই বাজার আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা পোশাক রপ্তানিতে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছি। ওই দেশগুলোর মানুষ এখন পোশাক কেনা কমিয়ে দিচ্ছেন। সে অবস্থায় ভারতসহ অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি বাড়ায় আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম।”
চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই ভারতে আমাদের রপ্তানি কমছে। কেনো কমেছে-আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি। সরকারকেও বিষয়টিকে নজর দিতে হবে।”
পারভেজ বলেন, “ভারতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। ভৌগোলিক কারণেই ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছিল। প্রায় দেড়শ’কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনবে।”
“আমাদের এই সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। কোথায় দুর্বলতা আছে; কী করতে হবে-তা দ্রুত করতে হবে,” বলেন দেশের অন্যতম বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইভিন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান আনোয়ার-উল আলম চৌধুরীফারুক হাসান।
তৈরি পোশাক ছাড়া ভারতে অন্য যে সব পণ্য রপ্তানি হয় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—পাট ও পাটজাতপণ্য, কটন ও কটন প্রোডাক্টস, প্লাস্টিক দ্রব্যাদি এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য।
চীনে উল্লম্ফন
ভারতে হোঁচট খেলেও বিশ্বের সর্বোচ্চ জনসংখ্যার দেশ চীনের বাজারে রপ্তানির পালে হাওয়া লেগেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশটিতে ৫১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪০ শতাংশ বেশি।
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে চীনে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে আয় হয়েছে ২২ কোটি ২ লাখ ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৭ দশমিক ৫১ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সাত মাসে চীনের বাজারে ৩৭ কোটি ৮ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিল বাংলাদেশ। পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছিল ১৪ কোটি ৯৩ লাখ ডলার।
জাপানে বেড়েছে ৩.১৪ শতাংশ
জুলাই-জানুয়ারি সময়ে জাপানে ১১৩ কোটি ৭৪ লাখ (১.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই সাত মাসে জাপানে ১১০ কোটি ২০ লাখ (১.১০ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।
রাশিয়ায় বাড়ছে, ফের আশার আলো
যুদ্ধের কারণে রাশিয়ায় পণ্য রপ্তানিতে যে ধাক্কা লেগেছিল, তা কেটে যেতে শুরু করেছে। দেশটিতে রপ্তানি ফের বাড়ছে।
চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩০ কোটি ৬১ লাখ ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ শতাংশ বেশি।
২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এই বাজারে ২৪ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন রপ্তানিকারকরা।
এই সাত মাসে দেশটিতে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ শতাংশ।
গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি সময়ে এই বাজারে ২২ কোটি ৭৭ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।
সম্ভাবনাময় বাজারে রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ানোয় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “তৈরি পোশাকের খুবই সম্ভাবনা এবং ভালো বাজার হয়ে উঠছিল রাশিয়া। অনেক দিন চেষ্টার ফলে আলো দেখা দিয়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম গত ২০২২-২৩ অর্থবছরেই দেশটিতে আমাদের রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলার অতিক্রম করবে।”
“কিন্তু যুদ্ধের কারণে সে আশায় হোঁচট খায়। রপ্তানি অনেক কমে যায়। এখন আবার বাড়ছে। যুদ্ধ থামেনি; এর মধ্যেও রপ্তানি বাড়া খুবই ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে। আশা করছি, রাশিয়ায় ১ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির আশা শিগগিরই পূরণ হবে।”
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাশিয়ায় বাজারে পণ্য রপ্তানি থেকে ১ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছিল সরকার। কিন্তু যুদ্ধের কারণে তা ধাক্কা খায়। শেষ পর্যন্ত ৪৬ কোটি ডলার আয় হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরে এই বাজারে ৬৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছিলেন রপ্তানিকারকরা।
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করে। এর পর থেকে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি কমতে থাকে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছর জুড়েই সেই নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে রাশিয়ায় বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়তে থাকে। ওই অর্থবছরে দেশটিতে ৪৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়।
২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেড়ে সেই রপ্তানি ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ২০ হাজার ডলারে গিয়ে উঠে। যা ছিল এ যাবতকালের সর্বোচ্চ।
কমেন্ট