রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন, ফেব্রুয়ারিতে বেড়েছে ১২%
সংকটের সময় রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে তা কেটে যাবে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করবে।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পর রপ্তানি আয়ও আশার আলো দেখাচ্ছে। ২০২৪ সালের দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৫১৮ কোটি ৭৫ লাখ (৫.১৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে ১২ দশমিক ০৪ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) সোমবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
সংকটের সময় রপ্তানি আয়ের এই উল্লম্ফনে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে তা কেটে যাবে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করবে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৬৩ কোটি (৪.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি মুদ্রা দেশে এসেছিল।
তবে, বছরের প্রথম মাস জানুয়ারির চেয়ে ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি আয় কম এসেছে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি।
জানুয়ারিতে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৭২ কোটি ৪৩ লাখ (৫.৭২ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছিলেন রপ্তানিকারকরা। একক মাসের হিসাবে এই আয় ছিল অতীতের যে কোনো মাসের চেয়ে বেশি।
এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৫৩৬ কোটি ৫২ লাখ (৬.৩৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ; যা এক মাসের হিসাবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পণ্য রপ্তানি থেকে ৩ হাজার ৮৪৫ কোটি ২২ লাখ (৩৩.২৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬ দশমিক ৪৮ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই আট মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৭ দশমিক ০৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি করে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ছিল ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
অক্টোবরের রপ্তানি আয় ছিল ২৬ মাস পর সবচেয়ে কম। ২০২১ সালের আগস্টে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিলেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।
তবে পরের মাস নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেশ খানিকটা বাড়ে; আসে ৪৭৮ কোটি ৪৮ লাখ (৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েক দিন বেশ কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ থাকার পরও নভেম্বরে অক্টোবরের চেয়ে বেশি আয় দেশে এসেছিল।
ডিসেম্বর মাসে এক লাফে বেড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়; আসে ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা। জানুয়ারিতে আসে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। সবশেষ ফেব্রুয়ারিতে এসেছে ৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে পাঁচ মাসে কেবল ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল। এর মধ্যে ২০২২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আসে যথাক্রমে ৫ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ও ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এসেছিল ৫ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। এই বছরের জানুয়ারিতে এসেছিল সবচেয়ে বেশি—৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার।
সদ্য শেষ হওয়া ফেব্রুয়ারি মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা ছিল ৫ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি মাসে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার দশমিক ৯৮ শতাংশ কম এসেছে।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে (জুলাই–অক্টোবর) পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে টানা তিন মাস (অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধি কমায় ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির গতি কমে দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমে আসে।
জানুয়ারিতে বাড়ায় প্রবৃদ্ধি বেড়ে ২ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারি শেষে তা আরও বেড়ে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
৮৫.৪৫ শতাংশই এসেছে পোশাক থেকে
জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প থেকে এসেছে ৩২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ১৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ। তবে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে ১ দশমিক ৩৯ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার; গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে দশমিক ২৬ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
এই আট মাসে পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩১ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির হিসাব বলছে, জুলাই-ফেব্রুয়ারি—এই আট মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ দশমিক ৪৫ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এটা ভালো যে,জানুয়ারির পর ফেব্রুয়ারি মাসেও সার্বিক রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নানা বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু আমরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা এখনও লেগে আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আমাদের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাবারের পেছনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে।”
“এর মধ্যেও পর পর দুই মাস ভালো রপ্তানি আমাদের আশান্বিত করেছে। তবে আগামী দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে কী না—চিন্তায় আছি আমরা।”
“আমরা প্রতাশা করবো এই ইতিবাচক ধারা যেনো অব্যাহত থাকে। আর সেটা যদি থাকে, তাহলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে, তা কেটে যাবে।”
তবে হতাশার কথা শুনিয়েছেন নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিটিএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “ইপিবির তথ্যের সঙ্গে আমরা আমাদের রপ্তানির তথ্যের মিল কুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের সবার রপ্তানি কমছে, আমরা কেউ ভালো নেই। অথচ ইপিবি বলছে, রপ্তানি বাড়ছে। ইপিবির তথ্য নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে।”
আগামী দিনগুলো কেমন যাবে—এ প্রশ্নের উত্তরে হাতেম বলেন, “ভালো যাওয়ার কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। গ্যাস সংকট লেগেই আছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও ভালো না। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি বাড়ার আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।”
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এই সংকটের সময় রপ্তানি আয় বাড়া স্বস্তির খবর। এই আয় রিজার্ভের পতন ঠেতাতে সহায়তা করবে।”
তবে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে এই ইতিবাচক ধারা যাতে আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকে সেটার দিকে রপ্তানিকারক ও সরকারকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
“মনে রাখতে হবে—এই মুহূর্তে রপ্তানি আয় যদি কমে যেতো, তাহলে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু আরও কমে যেত। তাতে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়ত। তাই আমি মনে করি, রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স যেনো বাড়ে, সেদিকেই সবার সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিৎ।”
অন্যান্য খাত
তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি আয় কমেছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) হিমায়তি মাছ রপ্তানি কমেছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ।
তবে এই আট মাসে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় ১২ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ১৬ দশমিক ৮২ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৩০ শতাংশ (৫২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন) তৈরি পোশাক থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে সব মিলিয়ে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে।
ফেব্রুয়ারিতে রেমিটেন্স বেড়েছে ৩৯%
রবিবার রেমিটেন্সের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) ১৫ দশমিক ০৬ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ বেশি।
সবশেষ ফেব্রুয়ারি মাসে ২১৬ কোটি ৬০ লাখ (২.১৬ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে। এই অঙ্ক আট মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত বছরের জুনে ২ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।
আর গত বছরের ফেব্রুয়ারির চেয়ে বেশি এসেছে ৩৯ শতাংশ। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৫৬ কোটি ৪ লাখ (১.৫৬ বিলিয়ন) ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
কমেন্ট