টানা ৪ মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে টানা চার মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে তা কেটে যাবে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে।
সংকটের মধ্যেও রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির পর মার্চ মাসেও পণ্য রপ্তানি থেকে ৫০০ কোটি (৫ বিলিয়ন) ডলারের বেশি আয় করেছে বাংলাদেশ।
এ নিয়ে টানা চার মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এল। এর আগে কখনই এমনটি দেখা যায়নি।
নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে টানা চার মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদরা। তারা বলেছেন, এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে তা কেটে যাবে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) মঙ্গলবার রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, সদ্য শেষ হওয়া মার্চ মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি থেকে ৫১০ কোটি ২৬ লাখ (৫.১০ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছে। এই অঙ্ক গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। তবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ৫১৪ কোটি (৫.১৫ বিলিয়ন) চেয়ে দশমিক ৮৮ শতাংশ কম।
২০২৩ সালের মার্চ মাসে ৪৬৪ কোটি ৩৯ লাখ (৪.৬৪ বিলিয়ন) ডলার আয় হয়েছিল।
গত বছরের নভেম্বরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল। ডিসেম্বরে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।
২০২৪ সালের প্রথম মাস জানুয়ারিতে তা বেড়ে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। একক মাসের হিসাবে এই অঙ্ক এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি।
দ্বিতীয় মাস ফেব্রুয়ারিতে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৫১৮ কোটি ৭৫ লাখ (৫.১৮ বিলিয়ন) ডলার দেশে এনেছেন রপ্তানিকারকরা।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৩৫৫ কোটি ৪৮ লাখ (৪৩.৫৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি। তবে ৪৬ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার লক্ষ্যের চেয়ে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম।
২০২২-২৩ অর্থবছরের এই নয় মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪১ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
অক্টোবর মাসে রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল। ওই মাসে পণ্য রপ্তানি করে ৩৭৬ কোটি ২০ লাখ (৩.৭৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ কম। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম ছিল ২৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ।
অক্টোবরের রপ্তানি আয় ছিল ২৬ মাস পর সবচেয়ে কম। ২০২১ সালের আগস্টে পণ্য রপ্তানি থেকে ৩৩৮ কোটি ৩০ লাখ (৩.৩৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিলেন বিভিন্ন খাতের রপ্তানিকারকরা।
তবে পরের মাস নভেম্বরে রপ্তানি আয় বেশ খানিকটা বাড়ে; আসে ৪৭৮ কোটি ৪৮ লাখ (৪.৭৮ বিলিয়ন) ডলার। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েক দিন বেশ কিছু পোশাক কারখানা বন্ধ থাকার পরও নভেম্বরে অক্টোবরের চেয়ে বেশি আয় দেশে এসেছিল।
ডিসেম্বর মাসে এক লাফে বেড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়; আসে ৫ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলারের বিদেশি মুদ্রা। জানুয়ারিতে আসে ৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। ফেব্রুয়ারিতে আসে ৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।
সবশেষ মার্চ মাসে এসেছে ৫ দশমিক ১০ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে ছয় মাসে কেবল ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছিল। এর মধ্যে ২০২২ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আসে যথাক্রমে ৫ দশমিক শূন্য নয় বিলিয়ন ও ৫ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে এসেছিল ৫ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। এই বছরের জানুয়ারিতে এসেছিল সবচেয়ে বেশি—৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। গত ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল ৫ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস শেষে (জুলাই–অক্টোবর) পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। তবে টানা তিন মাস (অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর) প্রবৃদ্ধি কমায় ছয় মাসের (জুলাই-ডিসেম্বর) হিসাবে সামগ্রিক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির গতি কমে দশমিক ৮৪ শতাংশে নেমে আসে।
জানুয়ারিতে রপ্তানি বাড়ায় প্রবৃদ্ধি বেড়ে ২ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও বেড়ে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশে ওঠে। মার্চে তা আরও বেড়ে ৪ দশমিক ৩৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
৮৫.৪১ শতাংশই এসেছে পোশাক থেকে
জুলাই-মার্চ সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্প থেকে এসেছে ৩৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ।
এর মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে এসেছে ২১ দশমিক ০১ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ। তবে লক্ষ্যের চেয়ে আয় কমেছে দশমিক ৯৬ শতাংশ।
ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ১৬ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার; গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আয় বেড়েছে দশমিক ৪৭ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কমেছে ৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
এই নয় মাসে পোশাক খাত থেকে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৯ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ৩৫ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
ইপিবির হিসাব বলছে, জুলাই-মার্চ—এই নয় মাসে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ দশমিক ৪১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে।
পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এটা ভালো যে, টানা চার মাস ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, নানা বাধা বিপত্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু আমরা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা এখনও লেগে আছে। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় আমাদের প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকার মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছে। তাদের এখন খাবারের পেছনে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমাদের এখন খারাপ সময় যাচ্ছে।”
“এর মধ্যেও রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছি আমরা। তবে আগামী দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে কী না—চিন্তায় আছি আমরা।”
“আমরা প্রতাশা করবো এই ইতিবাচক ধারা যেনো অব্যাহত থাকে। আর সেটা যদি থাকে, তাহলে রিজার্ভের উপর যে চাপ রয়েছে, তা কেটে যাবে। অর্থনীতিতেও স্বস্তি ফিরে আসবে।”
তবে হতাশার কথা শুনিয়েছেন নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিটিএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম। এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “ইপিবির তথ্যের সঙ্গে আমরা আমাদের রপ্তানির তথ্যের মিল খুঁজে পাচ্ছি না। আমাদের সবার রপ্তানি কমছে, আমরা কেউ ভালো নেই। অথচ ইপিবি বলছে, রপ্তানি বাড়ছে। ইপিবির তথ্য নিয়ে আমাদের প্রশ্ন আছে।”
আগামী দিনগুলো কেমন যাবে—এ প্রশ্নের উত্তরে হাতেম বলেন, “ভালো যাওয়ার কোনো লক্ষণ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। গ্যাস সংকট লেগেই আছে। বিশ্ব পরিস্থিতিও ভালো না। বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে রপ্তানি বাড়ার আশা করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়।”
অর্থনীতির গবেষক পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এই সংকটের সময় রপ্তানি আয় বাড়া স্বস্তির খবর। এই আয় রিজার্ভের পতন ঠেতাতে সহায়তা করবে।”
তবে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে এই ইতিবাচক ধারা যাতে আগামী দিনগুলোতে অব্যাহত থাকে সেটার দিকে রপ্তানিকারক ও সরকারকে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।
“মনে রাখতে হবে—এই মুহূর্তে রপ্তানি আয় যদি কমে যেতো, তাহলে আমাদের রিজার্ভ কিন্তু আরও কমে যেত। তাতে অর্থনীতিতে সংকট আরও বাড়ত। তাই আমি মনে করি, রিজার্ভের প্রধান দুই উৎস রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স যেনো বাড়ে, সেদিকেই সবার সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিৎ।”
অন্যান্য খাত
তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতেই রপ্তানি আয় কমেছে। চলতি অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-মার্চ) হিমায়তি মাছ রপ্তানি কমেছে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ২৬ শতাংশ।
তবে এই নয় মাসে ওষুধ রপ্তানি থেকে আয় ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৬২ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে সরকার। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৩০ শতাংশ (৫২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন) তৈরি পোশাক থেকে আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে সব মিলিয়ে ৫৫ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৪৭ বিলিয়ন ডলারই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে।
কমেন্ট