পোশাক খাতে ঢালাও সুবিধার কারণে রপ্তানি বহুমুখীকরণ হয়নি: এডিবি
ই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে শুল্ক আরোপিত হলে বা বেড়ে গেলে তার জেরে রপ্তানি ৫ দশমিক ৫ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বৈচিত্র্য কম। পুরো রপ্তানি খাত দিন দিন তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। মোট রপ্তানির আয়ের ৮৫ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। দীর্ঘদিন ধরে পোশাক খাতকে ঢালাও সুবিধা দেওয়ার কারণেই রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণ হয়নি।
এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে গেলে রপ্তানি পণ্যে যে শুল্ক আরোপিত হবে, তার জেরে বাংলাদেশের রপ্তানি কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ম্যানিলাভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) এক প্রতিবেদনে এ সব কথা বলা হয়েছে।
মঙ্গলবার প্রকাশিত ‘এক্সপ্যান্ডিং অ্যান্ড ডাইভারসিফাইং এক্সপোর্টস ইন বাংলাদেশ: চ্যালেঞ্জেস অ্যান্ড দ্য ওয়ে ফরোয়ার্ড’ শীর্ষক এডিবির এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে শুল্ক আরোপিত হলে বা বেড়ে গেলে তার জেরে রপ্তানি ৫ দশমিক ৫ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
এই বাস্তবতায় দেশের রপ্তানির সক্ষমতা বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে মনে করে সংস্থাটি।
দেশের রপ্তানি খাতে বৈচিত্র্য না আসার কারণ হিসেবে প্রণোদনা বৈষম্যের কথা উল্লেখ করেছে এডিবি। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,বাংলাদেশ সরকার সময়-সময় রপ্তানি খাতে যে প্রণোদনা দিয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি পোশাক খাতকে উদ্দেশ্য করে প্রণয়ন করা হয়েছে। শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি, বন্ডেড ওয়্যারহাউস–সুবিধা, আয়কর ছাড় বা রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল থেকে সহায়তা দেওয়াসহ বিভিন্ন ধরনের যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তার অনেকটি সব খাতের জন্য প্রযোজ্য ছিল।
কিন্তু দেখা গেছে, এসব সুবিধার বেশির ভাগই মূলত তৈরি পোশাক খাত পেয়েছে। এই শিল্প ১৯৯০-এর দশকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস–সুবিধা পেত; কিন্তু তখন তাদের নগদ সুবিধা দেওয়া হয়েছে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত।
পরবর্তী সময়ে তৈরি পোশাক খাতের সুবিধার যৌক্তিকীকরণ করা হলেও বন্ডেড ওয়্যারহাউস–সুবিধা অন্যান্য খাত পায়নি। ২০২৩ সাল পর্যন্ত পোশাক খাত ব্যতীত অন্যান্য রপ্তানিকারকেরা উচ্চ হারে করপোরেট কর দিয়েছে; এমনকি তাদের অর্থায়ন পাওয়ার সুযোগও ছিল সীমিত। দেশে ব্যবসার জগতে তৈরি পোশাক খাতের প্রভাব এতটাই বেশি যে নীতিগত সুবিধার সিংহভাগ তারাই পায় বলে মনে করে এডিবির।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ হাজার ৩৫৫ কোটি ৪৮ লাখ (৪৩.৫৫ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকে এসেছে ৩৭ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, মোট রপ্তানি আয়ের ৮৫ দশমিক ৪১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (২০২২ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের ৩০ জুন) ৫ হাজার ৫৫৫ কোটি ৮৮ লাখ (৫৫.৫৬ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যে তৈরি পোশাক থেকে এসেছিল ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার।
হিসাব বলছে, গত অর্থবছরে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ দশমিক ৫৮ শতাংশই এসেছিল তৈরি পোশাক থেকে।
এডিবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এলডিসি উত্তরণের পর বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে গড়পড়তা শুল্কের হার বেড়ে যেতে পারে। কানাডায় পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত; ভারতে ৮ দশমিক ৬; জাপানে ৮ দশমিক ৭ ও চীনে রপ্তানির ক্ষেত্রে ৭ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হতে পারে।
এ ছাড়া আমদানিতে ভারতের অগ্রাধিকার তালিকায় নেই—এমন অনেক পণ্য আবারও নেতিবাচক তালিকায় ঢুকে যেতে পারে।
এডিবি জানিয়েছে, তাদের এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত জানা যায়, বাংলাদেশের পণ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাবে না। এই সুবিধার আলোকে এলডিসি-বহির্ভূত দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়নে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায়। জিএসপি প্লাস সুবিধা না পেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপিত হতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জিএসপি প্লাস সুবিধা না পেলেও বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ‘ডেভেলপিং কান্ট্রিস ট্রেডিং স্কিম এনহান্সড প্রেফারেন্সেস’–এর আলোকে বাজার–সুবিধা পাবে। এতে অধিকাংশ পণ্যই শুল্কমুক্ত সুবিধা পাবে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে পণ্যের উৎসবিধি আরও কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হবে। এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে উৎসবিধি অতটা কঠোর না হলেও এ ক্ষেত্রে কঠোরভাবেই তা করা হবে।
বলা হয়েছে, এই সুবিধা পেতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতকে দ্বৈত রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদিত কাপড় ও সুতা ব্যবহার করতে হবে। তবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের সংযোগ শিল্পের যে অবস্থা, সেই বিবেচনায় এই শর্ত পূরণ কঠিন হবে।
বিদেশি বিনিয়োগ কমাও একটি কারণ
দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ কম হওয়ার কারণেও রপ্তানি খাত বহুমুখী হচ্ছে না বলে মনে করে এডিবি। এফডিআই এলে স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারের মিলন হয়। প্রযুক্তি, পুঁজি, ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা-স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এফডিআইয়ের কল্যাণে এসব লাভ করে। কিন্তু একদিকে বাংলাদেশে এফডিআই কম, অন্যদিকে যা আসে, তার বেশির ভাগ তৈরি পোশাক খাতকেন্দ্রিক। ফলে তৈরি পোশাক খাতের পক্ষে বৈশ্বিক বাজার ও ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব হয়েছে।
অন্যান্য খাত বিদেশি বিনিয়োগ না পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও বাজারের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ফলে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় প্রবেশের মতো সক্ষমতা তারা অর্জন করতে পারে না। বাংলাদেশও বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থার এক প্রান্তে থেকে যায় বলে এডিবি বলেছে।
সংস্থাটির তথ্যানুসারে, ২০০০ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ তার জিডিপির মাত্র ১ শতাংশের মতো এফডিআই পেয়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের শুল্কের উচ্চ হার বা সুরক্ষামূলক বাজারের কারণে রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করে এডিবি। উচ্চ শুল্ক থাকায় দেশি প্রতিষ্ঠানগুলো রপ্তানিতে আগ্রহী না হয়ে দেশি বাজারে মনোযোগ দেয়। সংস্থাটি মনে করে, শুল্ক কমানো হলে দেশি উৎপাদন উৎসাহিত হতে পারে। সেই সঙ্গে সব রপ্তানি খাতকেও একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে এডিবি।
এ ছাড়া মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে প্রজ্ঞার পরিচয় দেওয়া হলে রপ্তানি খাতের সক্ষমতা বাড়তে পারে বলে মনে করে এডিবি। সেই সঙ্গে এলডিসি উত্তরণ–পরবর্তী আলোচনার সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে এডিবি।
কমেন্ট