যেসব কারখানাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ

যেসব কারখানাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ

রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যপূরণে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ পরিকল্পিতভাবে উসকে দিতে কোনও কোনও মালিক তৎপর বলে অভিযোগ তুলেছেন শ্রমিক নেতারা।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে বঞ্চনা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, এবার তা ছড়িয়েছে পোশাক শিল্পেও। সেপ্টেম্বরের শুরু থেকে শ্রমিক অসন্তোষ-বিক্ষোভের জেরে একের পর এক বন্ধ হচ্ছে কারখানা। প্রতিদিনই বাড়ছে তার সংখ্যা। বৃহস্পতিবার ঢাকার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ২১৯টিতে।

বেতন ও হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ, টিফিন বিল বৃদ্ধি এবং সমানুপাতিকহারে পুরুষ শ্রমিক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে এসব কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ ঘোষণা করেছে বলে জানায় শিল্পাঞ্চল পুলিশ।

গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসে।

ড. ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে তৃতীয় ভাষণ দেন বুধবার। সেই ভাষণে তিনি তৈরি পোশাক শিল্প এলাকায় শ্রমিকরা ক্রমাগতভাবে যে কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য করছে, তা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যেসব কারখানা থেকে শ্রমিক অসন্তোষ ছড়াচ্ছে, তার বেশিরভাগের মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ বা সংশ্লিষ্টরা, যাদের অনেকের নামেই এরই মধ্যে মামলা হয়েছে, কিংবা তারা আছেন গা ঢাকা দিয়ে।

রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যপূরণে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ পরিকল্পিতভাবে উসকে দিতে কোনও কোনও মালিক তৎপর বলে অভিযোগ তুলেছেন শ্রমিক নেতারা।

গত ৯ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) অফিসে মালিক, শ্রমিক এবং আইনশৃংখলা বাহিনীর ত্রি-পক্ষীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টার সভা শেষ করে জানানো হয়, মঙ্গলবার থেকে খুলছে সব পোশাক কারখানা।

সেই সভায় সিদ্ধান্ত হয়, কোনও শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করা হবে না, শ্রমিক নিয়োগে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ হবে না, শ্রমিকদের টিফিনের জন্য ১০ টাকা বেশি বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং হাজিরা বোনাস ২২৫ টাকা বাড়ানো হবে।

বৃহস্পতিবার আশুলিয়া এলাকার কয়েকটি কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৯ সেপ্টেম্বরের সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করছে মালিকরা, এতে বেড়েছে অসন্তোষ।

শ্রমিকদের অভিযোগ, ১০ সেপ্টেম্বর কারখানা খোলার পর শ্রমিকরা কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চান তারা কী কী পাচ্ছেন। তবে কর্তৃপক্ষ সেসব নিয়ে কথা না এগিয়ে কারখানা ছুটি ঘোষণা করে দেয়। এতেই অস্থিরতা বাড়তে শুরু করে।

অভিযোগ উঠেছে, আন্দোলনের কারণে কোনও শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত হলেও সেটা মানা হয়নি। আর যাদের ছাঁটাই করা হয়েছে, তাদেরও কাজে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে না।

আশুলিয়ায় ২১৯ কারখানা বন্ধ

বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আশুলিয়ার শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১–এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের জেরে বৃহস্পতিবার ঢাকার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে কারখানা বন্দের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১৯টিতে। এসব কারখানার মধ্যে ১৩৩টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়া শ্রম আইন-২০০৬–এর ১৩ (১) ধারা অনুযায়ী বন্ধ রয়েছে ৮৬টি কারখানা।

সারোয়ার বলেন, “আশুলিয়ায় আজ (বৃহস্পতিবার) সকালে কারখানার কাজে যোগ দেন শ্রমিকেরা। তবে কিছু কারখানায় শ্রমিকরা বিভিন্ন দাবি জানায়। তখন কারখানাগুলোয় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়।”

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের নরসিংহপুর এলাকায় বিভিন্ন কারখানার সামনে সেনাবাহিনী, এপিবিএন ও পুলিশ সদস্যরা অবস্থান নেন। সড়কে টহল দিতে দেখা যায় সেনাবাহিনী, র‍্যাব, বিজিবি ও পুলিশ সদস্যদের।

পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, “গতকাল (বুধবার) থেকে আমরা শ্রমিকদের শান্তিপূর্ণভাবে কাজে যোগদান ও কাজ করতে মাইকিং করেছি। এই পরিস্থিতি থেকে কীভাবে উত্তরণ ঘটানো যায়, সে বিষয়ে সব পক্ষের সঙ্গে কথা হচ্ছে।

“দাবি-দাওয়া নিয়ে যেসব বিরোধ রয়েছে, তা কীভাবে নিষ্পত্তি করা যায়, তা নিয়েও কথা হচ্ছে। কলকারখানা অধিদপ্তরের যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, তাদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা চলছে।”

রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার অভিযোগ

যেসব কারখানা কেন্দ্র করে শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টির অভিযোগ আসছে, এগুলো হলো- নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ, একে আজাদের হামিম গ্রুপ, একে আজাদের ছোট ভাই ইসমাইল হোসেনের শারমীন গ্রুপ, সালাম মুর্শেদীর এনভয় গ্রুপ,  সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের ডি রোজ, সিদ্দিকুর রহমানের স্টার লিংক গ্রুপ এবং সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ।

এর মধ্যে আশুলিয়া এলাকার শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা যায়, ৮ সেপ্টম্বর (রবিবার) অসন্তোষ শুরু হয় নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপে একটি কারখানা থেকে। পরে সোমবার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সেদিন মীমাংসা হওয়ার পর মঙ্গলবার প্রথম যে কারখানা লাঞ্চের সময় ছুটি ঘোষণা করে, সেটি হামিম গ্রুপের একটি কারখানা।

গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সহ-সাধারণ সম্পাদক মঞ্জুর মঈন বলেন, “গত ৮ তারিখে আমরা দেখেছি গার্মেন্টসের সমস্যাগুলো কমে এসেছে। এর প্রেক্ষিতে ৯ তারিখ তিন পক্ষীয় সভা হয়। সেখান থেকে মালিকদের সঙ্গে একটা বোঝাপড়াও হয়। কিন্তু পরের দিন যখন কারখানায় শ্রমিকরা ফিরে যায়, তখন আমরা দেখেছি কোনও কারণ ছাড়াই কারখানা ছুটি ঘোষণা করে দিতে।

“শ্রমিকরা নিজ নিজ কারখানা থেকে আগের দিনের আলোচনা অনুযায়ী কী তারা পাবে, যেই জানতে চাচ্ছে তখনই কারখানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হচ্ছে। একটি কারখানায় ২০-৩০ হাজার শ্রমিক কাজ করে। একটি বন্ধ করলে তখন স্বাভাবিকভাবে বাকিগুলোতে প্রভাব পড়ে।”

‘এ ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে’ মন্তব্য করে মঈন এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “মালিকদের অনাগ্রহ এবং অসহযোগিতা সবচেয়ে বড় কারণ। যেসব কারখানা বা এর আশেপাশের কারখানায় আন্দোলন হচ্ছে, তার বেশিরভাগেরই মালিক আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট। তারা অনেকেই মামলার আসামি বা গা ঢাকা দিয়ে আছেন। তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য শ্রমিকদের ব্যবহার করতে চাচ্ছেন।

“যেসব দাবি কারখানায় মিটিয়ে ফেলা যায়, সেসব নিয়ে ইচ্ছাকৃত কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। তারা এসব মামলা বা তাদের অপরাধ থেকে বাচার জন্য এবং রাষ্ট্রকে চাপে ফেলতে এসব কাজ করে থাকতে পারেন।”

তিনি বলেন, “অবিলম্বে এসব দাবি কারখানা পর্যায়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হলে উৎপাদনে ফিরে যেতে চায় শ্রমিকরা। সরকারের এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।”

বিজিএমইএর সভাপতি, সহ-সভাপতিসহ একাধিক নেতাকে ফোন দিলেও তারা চলমান শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

বিজিএমইএর এক পরিচালক নাম না প্রকাশ শর্তে এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “এখন ইস্যুটা (শ্রমিক অসন্তোষ) কমপ্লিকেটেড হয়ে গেছে। এখানে নানান রকমের সুযোগ-সন্ধানী মুভ চলছে। আলোচনার মাধ্যমে একটা জায়গায় আমাদের পৌঁছাতে হবে।

“কারখানাগুলো চালু না হলে আমাদের জন্য খুব খারাপ হবে। শিল্পকে ঝুঁকির মধ্যে কেউ ফেলতে চাইলে তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ভূমিকার প্রয়োজন আছে।”

শনিবার সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বিজিএমইএ

এদিকে পোশাক শিল্পে চলমান শ্রম অসন্তোষ বিষয়ে শনিবার দুপুর ১২টায় এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে পোশার শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ অফিসে এই সভা হবে। এতে স্বরাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধি, বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও সব পোশাক শিল্প মালিকরা উপস্থিত থাকবেন বলে বিজিএমএই’র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

জুনে রপ্তানি আয় কমেছে ৫.৭৯ শতাংশ পরবর্তী

জুনে রপ্তানি আয় কমেছে ৫.৭৯ শতাংশ

কমেন্ট