ইলিশ রপ্তানি নিয়ে আগের অবস্থানেই আছি: ফরিদা
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যে প্রতিবেশী দেশটিতে ইলিশ রপ্তানি না করার পক্ষে অবস্থান জানিয়েছিলেন উপদেষ্টা ফরিদা। তিনি বলেছিলেন, ইলিশ আগে দেশের মানুষ পাবে, তারপরে রপ্তানি।
দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের ‘বিশেষ অনুরোধে’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে বলে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তবে ‘আমি আমার বক্তব্যের বিষয়ে আগের অবস্থানেই আছি’ বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
রোববার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে এক সভায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন ফরিদা আখতার।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েনের মধ্যে প্রতিবেশী দেশটিতে ইলিশ রপ্তানি না করার পক্ষে অবস্থান জানিয়েছিলেন উপদেষ্টা ফরিদা। তিনি বলেছিলেন, ইলিশ আগে দেশের মানুষ পাবে, তারপরে রপ্তানি।
কিন্তু গত শনিবার দূর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ৩ হাজার টন (৩০ লাখ কেজি) ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুমোদন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ নিয়ে রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নে ফরিদা আখতার বলেন, “বিশেষ অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আমার বক্তব্যের বিষয়ে আমি আগের অবস্থানেই আছি।”
উপদেষ্টা বলেন, “বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বাধীনভাবে এটা (রপ্তানির অনুমোদন) দিয়েছে। তারা একটা অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে দিয়েছে। ভারতের দুর্গাপূজা উপলক্ষে বিশেষ অনুরোধ ছিল। সে অনুযায়ী তারা করেছে। তাদের তো আমি জোর করতে পারি না।”
ফরিদা আখতার আরও বলেন, “অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দিয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের এখনো সেই কমিটমেন্টটা (প্রতিশ্রুতি) আগের মতোই আছে—বাংলাদেশের মানুষের ইলিশ প্রাপ্যতা যেন নিশ্চিত করতে পারি আমরা।”
দাম বাড়লে রপ্তানি নিরুৎসাহিত করবেন কি না—সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “যদি দাম বাড়ে, সে বিষয়ে অবশ্যই আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে।”
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রপ্তানি বন্ধের দায়িত্ব তো আমার না। আমি আহ্বান জানাতে পারি, কিন্তু বন্ধ করতে পারি না।”
রপ্তানি বা আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আছে বলেও উল্লেখ করেন ফরিদা আখতার।
দুর্গাপূজায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের মধ্যেও ইলিশের চাহিদাও বাড়ে। বাংলাদেশ ইলিশ রপ্তানি করছে না শুনে সেখানে হতাশাও শোনা গেছে।
তবে বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যবসায়ীরা ইলিশ রপ্তানির সুযোগ দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল।
বছরে প্রায় ৬ লাখ উৎপাদনের বিপরীতে রপ্তানির পরিমাণ নগন্য হওয়ার তথ্যটি তুলে ধরে ফরিদা বলেন, “গত বছর ৩ হাজার ৮০০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার টন।“
গত ১১ আগস্ট মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার জানিয়েছিলেন দুর্গাপূজাকে সামনে রেখে এ বছর বাংলাদেশ থেকে ভারতে কোনও ইলিশ মাছ পাঠানো হবে না।
সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ওই দিন ফরিদা আখতার বলেছিলেন, “দেশের মানুষের চাহিদা মিটিয়ে তারপর ইলিশ মাছ বিদেশে রপ্তানি করা হবে। দেশের মানুষ যাতে ইলিশ মাছ পায় এবং দাম কমে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর রপ্তানি হবে সেটা হতে পারে না।”
“ফলে এবার দুর্গাপূজায়ও ভারতে যাতে কোনও ইলিশ না যায় তার জন্য আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে বলেছি। অবৈধ পথেও যেন কোনও ইলিশ যেতে না পারে সে বিষয়ে সীমান্ত এলাকায় কঠোর থাকতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করেছি,” বলেছিলেন ফরিদা আখতার।
স্বল্প আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়া ইলিশ মাছের দাম নাগালের মধ্যে নিয়ে আসারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন উপদেষ্টা।
গত কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচারের সময় ইলিশ জব্দের বেশ কিছু খবর সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
দুর্গাপূজা ঘিরে প্রতি বছরের মত এবারও বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আমদানি করতে চেয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর চিঠি দেয় ভারত।
ভারতীয় ব্যবসায়ীদের চিঠিতে বলা হয়, ১৯৯৬ সালের পর থেকে প্রতিবছর গড়ে ৫ হাজার টন ইলিশ বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানি হচ্ছিল। তবে ২০১২ সালের পর থেকে রপ্তানি অজ্ঞাত কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আবার গত পাঁচ বছর ধরে কেবল দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে বিশেষ বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে ইলিশ যাচ্ছিল।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ইলিশ আমদানির সুযোগ চেয়েছিলেন ভারতের ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ ইলিশ মাছের অবদান। মৎস্যজীবীরা প্রতি বছর প্রায় ৬ লাখ টন ইলিশ ধরে। এর অধিকাংশই সমুদ্র থেকে ধরা হয়।
২০১৭ সালে ইলিশকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সূচক হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তবে ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত রপ্তানি বন্ধ ছিল।
সবশেষ গতবছর দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ৩ হাজার ৯৫০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশের ৭৯টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিকে ৫০ টন করে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয়।
ওই বছর ১১ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জানিয়েছিলেন, চার বছরে ভারতে ৫ হাজার ৫৪১ মেট্রিকটন ইলিশ রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
গত ৫ বছর ধরে ভারতে ইলিশ আমদানি হয়েছে বাংলাদেশ থেকে। এবারও সেই রীতি মেনে ভারতে ইলিশ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের কাছে আবেদন করে ফিস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন।
‘নদীপথ ঠিক করে দিন’
বিশ্ব নদী দিবসে সাংবাদিকদের সামনে এসে ইলিশের বিচরণ পথের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন উবিনীগের নির্বাহী পরিচালক ফরিদা আখতার।
তিনি বলেন, “আজ বিশ্ব নদী দিবস। এই দিবসে যেটা শুনলাম, সেটা হলো সাগর থেকে ইলিশ মাছ নদীতে আসতে পারছে না। এটা আমার কাছে শিউরে ওঠার মতো একটি তথ্য। নদীগুলো ভরাট হওয়ার কারণে, নানাভাবে দখল হওয়ার কারণে, ইলিশ মাছ নদীতে প্রবেশের পথ যেভাবে নষ্ট হচ্ছে। এই পথটা যদি ইলিশ মাছকে আমরা দিতে না পারি তাহলে এটা নিয়ে বড় বড় কথা বলে কোনো লাভ নেই।”
এবিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে উপদেষ্টা ফরিদা বলেন, “নদীপথগুলোকে ঠিক করে দেন। ইলিশ মাছকে আসতেও দিতে হবে, যেতেও দিতে হবে। আসা ও যাওয়ার পথ ঠিক না করলে আমরা কেউ ইলিশ পাব না।”
ইলিশ বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য হিসাবে স্বীকৃত। সাগরের এই মাছ কেবল ডিম ছাড়ার জন্যই নদীতে আসে।
কমেন্ট