যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমছে সবচেয়ে বেশি
২০২২ সালে এই বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। কিন্তু গত বছর প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো ২৫ শতাংশ কমেছিল। সেই নেতিবাচক ধারা চলতি বছরেরও অব্যাহত রয়েছে।
একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মত আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি থেকে।
২০২২ সালে এই বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। কিন্তু গত বছর প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো ২৫ শতাংশ কমেছিল। সেই নেতিবাচক ধারা চলতি বছরেরও অব্যাহত রয়েছে।
উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমছে সবচেয়ে বেশি।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি ২০২৪ সালের আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) বাজারটিতে ৪৭১ কোটি (৪.১৭ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তাকিারকরা। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ কম।
এই তথ্য বলছে, বড় এই বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, বন্যা ও শ্রম অসন্তোষের কারণে তিন মাস ধরে পোশাক খাতের উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ পরিস্থিতে পোশাক শিল্পমালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের সঙ্গে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ‘খুব ভালো’ সম্পর্ক থাকলেও দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশটিতে রপ্তানি বাড়বে—এমনটা আশা করতে পারছেন না তারা। উল্টো আরও কমে যেতে পারে—এই শঙ্কায় আছেন তারা।
অটেক্সার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চলতি বছরের প্রথম আট মাসে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৫ হাজার ১৩০ কোটি ৩১ লাখ (৫১.৩০ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছেন। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ কম।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বরাবরই শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ যথাক্রমে চীন ও ভিয়েতনাম। যদিও কয়েক বছর ধরে এই বাজারে চীনের হিস্যা কমছে; বাড়ছে ভিয়েতনামের। চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে এই বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে ভিয়েতনাম।
অটেক্সার তথ্যে দেখা যায়, এই আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশের পোশাক রপ্তানিই কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে বাংলাদেশের। গত বছর এই বাজারে বাংলাদেশ ৭২৯ কোটি (৭.২৯ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছিল।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হিস্যার ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ দখলে নিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ চীন। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে এক হাজার ৬৯ কোটি ১০ লাখ (১০.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে দেশটি। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৭০ শতাংশ কম। গত বছরের এই আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চীনের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১০ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলার।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক ভিয়েতনাম চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে ৯৫৫ কোটি ৬৯ লাখ (৯.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৯ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন) ডলারে। সেই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ।
অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পোশাক রপ্তানিও কমেছে। চলতি বছরের আট মাসে ভারত ৩২১ কোটি ৩২ লাখ (৩.২১ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। তাদের রপ্তানি কমেছে ১ দশমিক ৫ শতাংশ।
অন্যদিকে ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ১৩ শতাংশ। তাদের রপ্তানির পরিমাণ ২৬৮ কোটি ৪৭ লাখ (২.৬৮ বিলিয়ন) ডলার। আমেরিকার বাজারে ভারত ও ইন্দোনেশিয়া যথাক্রমে চতুর্থ ও পঞ্চম শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমে যায়। পাশাপাশি এই বাজারে আরেক দুশ্চিন্তাও তৈরি হয় চলতি বছর। মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দপ্তরের (ইউএসটিআর) অনুরোধে বাংলাদেশসহ শীর্ষ পাঁচ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ নিয়ে তদন্ত শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন (ইউএসআইটিসি)। কীভাবে এ দেশগুলো মার্কিন পোশাকশিল্পের বাজারের এত বড় অংশ দখল করে রেখেছে, তা তথ্যানুসন্ধান করে দেখবে কমিশন।
এই পাঁচ দেশের কেউ অসুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজার দখল করেছে কি না—তা খুঁজে বের করাই প্রধান উদ্দেশ্য এ কমিশনের। অন্য চার দেশ হলো ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও পাকিস্তান।
জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে কম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২২৯ কোটি ২৮ লাখ (২.২৯ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে পাকিস্তান বাজারটিতে ১৩৮ কোটি ৬২ লাখ (১.৩৮ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। যা গত বছরের জানুয়ারি-আগস্টের চেয়ে ১ দশমিক ১৫ শতাংশ বেশি।
২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা মোট ৯ হাজার ৯৮৬ কোটি (৯৯.৮৬ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছিলেন। ২০২৩ সালে সেটি ২২ শতাংশ কমে যায়। ওই বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৭ হাজার ৭৮৪ কোটি (৭৭.৮৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। গত বছর এই বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষ পাঁচ দেশের রপ্তানি প্রায় একই হারে কমেছিল।
চলতি বছরে ব্যবসা কিছুটা বাড়তে থাকে। তবে শীর্ষ পাঁচ দেশের কোনো দেশই এখনও প্রবৃদ্ধির মুখ দেখেনি।
চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্ট সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চীন ও ভিয়েতনাম থেকেই ৩৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ তৈরি পোশাক আমদানির করছেন। আর বাংলাদেশ থেকে করেছেন ৯ দশমিক ১৮ শতাংশ। এই বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার হিস্যা যথাক্রমে ৬ দশমিক ২৬ ও ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ।
পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতিও বেড়ে গিয়েছিল। সে কারণে ওই দেশের মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছিল। যার ফলে দেশটিতে বাংলাদেশসহ সব দেশের রপ্তানিই কমে গিয়েছিল।”
“যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি কমে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এখন দেশটি পোশাক আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক শিল্পের অস্থিরতা আমাদের আরেক চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। শ্রমিক অসন্তোষ-বিক্ষোভে অনেক কারাখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী দিনগুলোতে কী হবে—এ নিয়ে চিন্তার মধ্যে আছেন পোশাক শিল্পমালিকরা। সবার মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করছে। এমন চলতে থাকলে আমাদের রপ্তানি কমে যাবে।”
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ঘরে উঠে যায়। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ—ফেডের লক্ষ্যমাত্রা ছিল মূল্যস্ফীতির হার ২ শতাংশের মধ্যে রাখা। ফলে ফেড আগ্রাসীভাবে নীতি সুদহার বাড়াতে শুরু করে এবং এর জেরে মূল্যস্ফীতির হার কমতে কমতে আগস্ট মাসে ২ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে।
অর্থাৎ ফেডারেল রিজার্ভের লক্ষ্যমাত্রা ২ শতাংশের কাছাকাছি চলে এসেছে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর এটাই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বনিম্ন মূল্যস্ফীতি। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ; আগস্টে হয়েছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ।
অবশ্য নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজার নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা। যদিও কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান, বন্যা ও শ্রম অসন্তোষের কারণে তিন মাস ধরে পোশাক খাতের উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ানো নিয়ে খুবই আশাবাদী। ইতিমধ্যে মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছেন ১৯৮ বিশ্বনেতা। তাদের মধ্যে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাসহ ৯২ জন নোবেলজয়ী রয়েছেন। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করছি।”
কমেন্ট