পোশাক শিল্পে ক্ষতি ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা

পোশাক শিল্পে ক্ষতি ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা

সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “শ্রমিক অসন্তোষের ফলে ৪০ কোটি ডলারের পোশাক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে বলে জানতে পারছি। এটি আরও বাড়বে।”

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে যে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, তাতে অন্তত ৪০ কোটি ডলারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে এক হিসাব দিয়েছে বিজিএমইএ। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে এই অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।

পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠনটি শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে এ তথ্য জানানোর পাশাপাশি সংকট কাটাতে কিছু দাবি তুলে ধরেছে।

রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে আয়োজিত এ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, “শ্রমিক অসন্তোষের ফলে ৪০ কোটি ডলারের পোশাক উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। প্রতিনিয়ত ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে বলে জানতে পারছি। এটি আরও বাড়বে।”

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে দেশজুড়ে সহিংসতা, মৃত্যু, ইন্টারনেট বন্ধ, কারফিউ-এর কারণে  জুলাই মাসে কয়েক দিন পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল।

এরপর ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই গাজীপুর; ঢাকার সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে পোশাক শ্রমিকরা নানা দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। কোথাও কোথাও সড়ক অবরোধের পাশাপাশি সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে।

এই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটিয়ে পোশাক খাত বর্তমানে ‘স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে’ মন্তব্য করে রফিকুল বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কিছু কার্যাদেশ প্রতিযোগী দেশগুলোতে স্থানান্তরিত হয়েছে।

তবে বর্তমানে স্থিতিশীলতা ‘পুনরুদ্ধার হওয়ায়’ আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো আবার ফিরে আসছে বলে দাবি করেন তিনি।

লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, “বিজিএমইএ বোর্ডের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সরকারের নির্দেশনায় পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তায় সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথবাহিনী গঠন হয়েছে এবং যৌথবাহিনী গার্মেন্টস অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিয়মিতভাবে টহল পরিচালনা করেছে। বিজিএমইএ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কমিউনিটি পুলিশিং চালু করেছে।

“পোশাক কারখানাগুলোতে অগাস্ট মাসের বেতন পরিশোধে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়ায় বিজিএমইএ থেকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা চেয়ে অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দেওয়া হয় ও বিজিএমইএ বোর্ড বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দেখা করেন। বিজিএমইএ’র অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক অগাস্ট মাসের বেতনভাতা পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে।”

শ্রম অসন্তোষে আশুলিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩৯টি পোশাক কারখানার সেপ্টেম্বর মাসের বেতনভাতা পরিশোধের ক্ষমতা ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, ওই সব কারখানা যাতে বিপদে না পড়ে, সেজন্য তাদেরকে সুদহীন সহজ শর্তের ঋণ দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

রফিকুল বলেন, পোশাক শিল্পের ৪০ লাখ শ্রমিক যাতে ন্যায্য মূল্যে পণ্য পান, সেজন্য তাদেরকে টিসিবির কর্মসূচিতে নেওয়া হয়েছে।

শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তিন মাস যাতে কোনো কারখানায় গ্যাস-বিদ্যুতের লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন না করা হয়, সেজন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। একইসঙ্গে ব্যাংক সুদের হার একক অংকে নামিয়ে আনারও আহ্বান জানান।

বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি কাজের শৃঙ্খলা বজায় রাখা পোশাক শিল্পের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা, কারখানাগুলো বর্তমানে চালু আছে।”

শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শিল্প কারখানায় তিন মাসের জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের মতো জরুরি সেবা বিচ্ছিন্ন না করার জন্য সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর) রপ্তানি আয়ের তথ্য প্রকাশ করেছে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যরো। তাতে দেখা যায়, এই তিন মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ১ হাজার ১৩৭ কোটি (১১.৩৭ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এর মধ্যে ৯২৯ কোটি (৯.২৯ বিলিয়ন) ডলার এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে; প্রবৃদ্ধি হয়েছে বেড়েছে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ।

হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে মোট রপ্তানি আয়ের ৮২ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।

ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম।

এর মধ্যে ৩৬ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল তৈরি পোশাক থেকে; ওভেন পোশাক থেকে এসেছিল ১৬ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। আর নিট পোশাক থেকে এসেছিল ১৯ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার।

সঙ্কট নিরসনে বিজিএমইএর দাবি

সংবাদ সম্মেলনে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে সরকারের কাছে কয়েকটি দাবি জানান। সেগুলো হচ্ছে—

>> শিল্পে সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে।

>> কাস্টমস বন্দর সংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো সহজতর ও দ্রুততর করতে হবে।

>> চট্টগ্রাম বন্দরে লোডিং ও আনলোডিংয়ে অহেতুক সময়ক্ষেপণ বন্ধ করতে হবে।

>> আগামী ৩ মাস কারখানার ইউটিলিটি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা যাবে না।

>> ব্যাংকখাতের সংস্কার যেন উৎপাদন ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে।

>> কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নে্রয়ার কারণে কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

>> শিল্পকে ব্যবসাবান্ধব করতে যথাযথ নীতি সহায়তা প্রনয়ণের বিষয়ে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংক সমন্বয়ে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করতে হবে।

>> শিল্পে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা ও বিদ্যুতের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণসহ একটি টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করতে হবে।

>> সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ঋণ শ্রেণিকরণ না করা এবং পুনঃতফসিলকরণের সুযোগ দিতে হবে।

>> তৈরি পোশাক কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে জরুরি ভিত্তিতে সিএনজি স্টেশন থেকে সিলিন্ডারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহের নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।

>> ঝুটসহ অন্যান্য রিসাইকেলিং উপযোগী বর্জ্য অপসারণকে বাইরের প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।

>> পোশাক খাতের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রণোদনা পুনর্বহালের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

>> পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি নিরাপদ এক্সিট পলিসির ব্যবস্থা করতে হবে।

এবং

>> শিল্পে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারীদের কঠোর আইনের আওতায় আনতে হবে।

বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব, সহসভাপতি নাছির উদ্দিন, রকিবুল আলম চৌধুরী, পরিচালক শোভন ইসলাম, শামস মাহমুদ, রাজিব চৌধুরী, জাকির হোসেন, মহিউদ্দিন রুবেল, শেহরিন সালাম ঐশী, নুরুল ইসলাম, সাইফুদ্দিন সিদ্দিকী সাগর, রেজাউল আলম মিরু সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমছে সবচেয়ে বেশি পরবর্তী

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমছে সবচেয়ে বেশি

কমেন্ট