রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন, অক্টোবরে বেড়েছে ২০.৬%
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।
রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষে কারখানা বন্ধসহ নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) নতুন হিসাবে প্রতি মাসেই বাড়ছে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান উৎস রপ্তানি আয়।
রিজার্ভের আরেক উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সও বাড়ছে বেশ ভালো গতিতে। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই দুই সূচকের ইতিবাচক ধারা এতে রিজার্ভের সংকট কেটে যাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা।
তবে, অক্টোবরের রপ্তানি আয়ের উল্লম্ফনে অবাক হয়েছেন রপ্তানিকারকরা। সংকটের মধ্যেও রপ্তানি আয় এতোটা বাড়বে আশা করেননি নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহামামদ হাতেম।
তিনি বলেছেন, “ইপিবির এই তথ্য আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। আমরা রপ্তানি করে যে আয় করছি, তার সঙ্গে ইপিবির তথ্যের প্রতিফলন নেই। আমাদের আয় বাড়ছে না। অথচ ইপিবি বলছে, বাড়ছে। কি ভাবে সম্ভব হচ্ছে, জানিনা।”
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২০ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার।
অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) রপ্তানি আয় বেড়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। এই চার মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ১৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রবিবার রপ্তানি আয়ের এই হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় অক্টোবরে। অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ৯ শতাংশ।
দ্বিতীয় মাস আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ; আয় হয়েছে ৪ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলার। তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বর আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইপিবি। রপ্তানিকারকরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন যে ইপিবি রপ্তানি আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে।
এর পর থেকে রপ্তানি আয়ের সংশোধিত বা প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে ইপিবি। গরমিল ধরা পরার পর গত ৯ অক্টোবর চলতি অর্থবছরের তিন মাসের (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করেছিল ইপিবি। রবিবার অক্টোবর মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ২৩ শতাংশ
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, অক্টোবরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। যা গতবছরের অক্টোবরের চেয়ে ২২ দশমিক ৮০ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের অক্টোবরে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ২ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর সময়ে মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮১ দশমিক ১৩ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এই চার মাসে ১২ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১১ কোটি ৫০ বিলিয়ন ডলার।
হিসাব বলছে, জুলাই-অক্টোবর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
এই চার মাসে নিট পোশাক লপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৭ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৫ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
অন্যান্য খাত
অক্টোবরে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য সব খাতের মধ্যে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে; বাকি খাতগুলো থেকে কমেছে।
অক্টোবরে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ১১ কোটি ৩১ লাখ ডলার আয় হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে এই আয়ের অঙ্ক ছিল ১০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ শতাংশ।
চার মাসের (জুলাই-অক্টোবর) হিসাবে কৃষি পণ্য থেকে আয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
অক্টোবরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে ১ শতাংশ। তবে চার মাসের হিসাবে বেড়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ।
অক্টোবরে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় কমেছে ৭ দশমিক ৬শতাংশ; জুলাই-অক্টোবর সময়ে কমেছে আরও বেশি ১৩ দশমিক ৭০ শতাংশ।
অক্টোবরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় কমেছে দশমিক ৪ শতাংশ; চার মাসে কমেছে ১ দশমিক ৩১ শতাংশ।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪০ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছে অন্তবর্তীকালীন সরকার।
কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক খাতের উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। গত শনিবারও গাজীপুরের বাসন এলাকায় বকেয়া বেতনের দাবিতে টিঅ্যান্ডজেড অ্যাপারেলস গ্রুপের পাঁচটি কারখানার পোশাকশ্রমিকরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন।
শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনকে ঘিরে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্দোলন সংঘাতে দেশে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।
এর মধ্যে গাজীপুর ও ঢাকার সাভারে শ্রমিক অসন্তোষের বেশ কয়েক দিন অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকে; উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়।
পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ গত ১৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অন্তত ৪০ কোটি ডলারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে ওই অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর অস্থিরতার মধ্যেও রপ্তানি আয় বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “জুলাই-অগাস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর পরও রপ্তানি আয় বাড়ায় আমরা খুশি। তবে আমাদের অর্ডার কিন্তু কমছে। জানি না আগামী মাসগুলোতে কি হবে।”
তিনি বলেন, “চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। আমাদের হিসাবে জুলাই মাসের মধ্যে এক সপ্তাহেই পোশাক শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারের উপরে। আর ব্যাংক বন্ধ থাকায় তো রপ্তানির উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”
“এই অস্থিরতা-অনিশ্চতা না থাকলে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়ত,” বলেন হাতেম।
কমেন্ট