টানা দুই মাস ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয়
সবশেষ নভেম্বর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪১১ কোটি ৯৭ লাখ (৪.১২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের নভেম্বর মাসের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি।
পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষে কারখানা বন্ধসহ নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে প্রতি মাসেই বাড়ছে দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে উদ্বেগজনক সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের প্রধান উৎস রপ্তানি আয়।
সবশেষ নভেম্বর মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪১১ কোটি ৯৭ লাখ (৪.১২ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের নভেম্বর মাসের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ বেশি।
এ নিয়ে টানা দুই মাস ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় দেশে এসেছে। আগের মাস অক্টোবরে এসেছিল ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২০ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
আগের মাস সেপ্টেম্বরে আয় হয়েছিল ৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছিল ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ।
আগস্ট ও জুলাইয়ে আয় হয় যথাক্রমে ৪ দশমিক শূন্য তিন ও ৩ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৫ দশমিক ৬১ ও ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
সব মিলিয়ে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) রপ্তানি আয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এই পাঁচ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট আয় হয়েছে ১৯ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে আয় হয়েছিল ১৭ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার।
বুধবার বিকালে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন সংবাদ সম্মেলন করে রপ্তানি আয়ের এই তথ্য প্রকাশ করেন। রাজধানী ঢাকার কারওয়ান বাজারে ইপিবি অফিসে এই সংবাদ সম্মেলন হয়।
ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, “পোশাক রপ্তানিতে পিক মৌসুম চলছে। এই সময় বরাবরই আমাদের রপ্তানি বাড়ে। বড়দিনকে সামনে রেখেও রপ্তানি বাড়ছে। সব মিলিয়ে ইতিবাচক ধারায় রয়েছে আমাদের রপ্তানি খাত। আশা করছি, সামনের দিনগুলোতেও এই ধারা বজায় থাকবে।”
রপ্তানিকারকরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছিলেন, ইপিবি রপ্তানি আয়ের ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিচ্ছে। গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে রপ্তানি আয়ের হিসাবে বড় ধরনের গরমিল ধরা পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে ইপিবি।
এর পর রপ্তানি আয়ের সংশোধিত বা প্রকৃত তথ্য প্রকাশ করছে ইপিবি। গরমিল ধরা পরার পর গত ৯ অক্টোবর চলতি অর্থবছরের তিন মাসের (প্রথম প্রান্তিক, জুলাই-সেপ্টেম্বর) তথ্য একসঙ্গে প্রকাশ করেছিল ইপিবি।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) নভেম্বর মাসের তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১৬ শতাংশ
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, নভেম্বরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ১৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের নভেম্বরে পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল ২ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলার।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ৮১ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে। এই পাঁচ মাসে ১৬ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ১২ কোটি ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
হিসাব বলছে, জুলাই-নভেম্বর সময়ে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১২ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
এই পাঁচ মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৮ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ২৩ শতাংশ। ওভেন পোশাক থেকে এসেছে ৭ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার; বেড়েছে ১২ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
অন্যান্য খাত
নভেম্বরে তৈরি পোশাক ছাড়া অন্য খাতের মধ্যে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। নভেম্বরে কৃষি পণ্য রপ্তানি থেকে ১১ কোটি ডলার আয় হয়েছে। গত বছরের নভেম্বরে এই আয়ের অঙ্ক ছিল ৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ।
পাঁচ মাসের (জুলাই-নভেম্বর) হিসাবে কৃষি পণ্য থেকে আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ।
নভেম্বরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে আয় কমেছে দশমিক ৩৫ শতাংশ। তবে পাঁচ মাসের হিসাবে বেড়েছে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ।
নভেম্বরে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে আয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ; তবে জুলাই-নভেম্বর সময়ে কমেছে ১০ শতাংশ।
নভেম্বরে হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় বেড়েছে ২০ দশমিক ৭৪ শতাংশ; পাঁচ মাসে বেড়েছে ৫ দশমিক ০৩ শতাংশ।
গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ, যা ছিল আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) চেয়ে ৪ দশমিক ২২ শতাংশ কম।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে মোট ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য ধরেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় সংঘাতময় পরিস্থিতিতে পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি ব্যাহত হয়। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।
এর মধ্যে গাজীপুর ও ঢাকার সাভারে শ্রমিক অসন্তোষের বেশ কয়েক দিন অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকে; উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে এখনও স্বাভাবিক হয়নি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এ খাতের কর্মকাণ্ড।
পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ গত ১৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অন্তত ৪০ কোটি ডলারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে ওই অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর অস্থিরতার মধ্যেও রপ্তানি আয় বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।
এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “জুলাই-অগাস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরপরও রপ্তানি আয় বাড়ায় আমরা খুশি। তবে আমাদের অর্ডার কিন্তু কমছে। জানি না আগামী মাসগুলোতে কী হবে।”
হাতেম বলেন, “চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে। আমাদের হিসাবে জুলাই মাসের মধ্যে এক সপ্তাহেই পোশাক শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ১ বিলিয়ন ডলারের উপরে। আর ব্যাংক বন্ধ থাকায় তো রপ্তানির উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”
“এই অস্থিরতা-অনিশ্চতা না থাকলে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়ত”, বলেন বিকেএমইএ সভাপতি।
রিজার্ভ বাড়ছে
রিজার্ভের আরেক উৎস প্রবাসীদের পাঠানো অর্থও বাড়ছে বেশ ভালো গতিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) এক হাজার ১১৩ কোটি ৭৩ লাখ (১১.১৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে দেশে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ায় রিজার্ভও বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংক যে ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) হিসাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে ২০ নভেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৮ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার।
দুই সপ্তাহ আগে ১৪ নভেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ১৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সপ্তাহের ব্যবধানে বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ বেড়েছে ২৩ কোটি ডলার। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০ কোটি ডলার।
গত ১২ নভেম্বর এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মেয়াদের ১ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল পরিশোধের পর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ কমে ১৮ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। ‘গ্রস’ হিসাবে রিজার্ভ নেমেছিল ২৪ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে।
তার আগে ৭ নভেম্বর বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার। ‘গ্রস’ হিসাবে ছিল ২৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার ‘উইকলি সিলেক্টেড ইকোনমিক ইন্ডিকেটরস’ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে রিজার্ভের পাশপাশি অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকের হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়।
কমেন্ট