বৈরি সম্পর্কের মধ্যেও ভারতে রপ্তানি বাড়ছে

বৈরি সম্পর্কের মধ্যেও ভারতে রপ্তানি বাড়ছে

বেনাপোল-পেট্রাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্য বেশি হয়ে থাকে। ফাইল ছবি

চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাস আগস্ট থেকেই ভারতের সঙ্গে কূটনতিক সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে বাংলাদেশের; পঞ্চম মাসে এসে তা আরও তীব্র হয়েছে; তবে রাজনৈতিক এই সংকটের প্রভাব এখনও দেখা যাচ্ছে না অর্থনীতিতে। গত পাঁচ মাসে ভারতে পণ্য রপ্তানি আগের বছরের চেয়ে বেশিই দেখা যাচ্ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ভারতে ৮০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশ বেশি।

রাজনৈতিক সম্পর্কের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের মিল এখনও ধরা না পড়লেও চলমান সংকটের আশু সমাধান না হলে আগামী দিনগুলোতে রপ্তানির এই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশ যত পণ্য আমদানি করে তার অনেক কমই রপ্তানি করে থাকে।

অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ভারতে রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় বাংলাদেশের সেটাই প্রথম।

তার আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ভারতে পণ্য রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আয় করেছিল ১৯৯ কোটি ১৪ লাখ (১.৯৯ বিলিয়ন) ডলার। যা ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ৫৫ দশমিক ৬২ শতাংশ বেশি।

তবে গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সেই রপ্তানিতে ভাটা পড়ে; আয় নেমে আসে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলারে।

গত জুলাই মাসে অর্থ বছরের শুরুতেই বাংলাদেশে কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়। তা আগস্টের শুরুতেই জনবিস্ফোরণে রূপ নিলে পতন ঘটে শেখ হাসিনার সরকারের। তিনি পালিয়ে আশ্রয় নেন ভারতে।

এরপর থেকে ঢাকা-নয়া দিল্লি কূটনৈতিক টানাপড়েন চললেও নভেম্বরে এসে তা তীব্রতা পায় হিন্দু ধর্মীয় নেতা চিন্ময় ব্রহ্মচারী গ্রেপ্তারের পর।

তার জেরে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে এক বিক্ষোভ থেকে বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে হামলা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধেরও হুমকি দিয়েছেন।

অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বৈরিতার দিকে চলার প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠন ও ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

এই উত্তেজনার মধ্যেই রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গত বৃহস্পতিবার রপ্তানি আয়ের দেশভিত্তিক যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে গত পাঁচ মাসে ভারতে পণ্য রপ্তানিতে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।

রপ্তানির হাল

গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ভারতে ৮০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৭০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।

২০১১ সালে ভারত বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। তবে সেই সুবিধা খুব বেশি কাজে লাগাতে পারছিল না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।

ওই বছরের শেষের দিকে বাংলাদেশের বেশ কিছু কারখানার কাছ থেকে পোশাক নিয়ে টাকা দেয়নি ভারতীয় কোম্পানি লিলিপুট। সে জন্য বেশ কয়েক বছর পোশাক রপ্তানিতেও ভাটা পড়েছিল।

এরপর ভারতে রপ্তানি ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশটিতে পণ্য রপ্তানি আয় ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। পাঁচ বছরের মাথায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেই আয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ২ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলারে ওঠে।

বাংলাদেশের ইতিহাসে তার আগে মাত্র চারটি অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানি ১ বিলিয়ন (১০০ কোটি) ডলারের বেশি হয়।

২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা ভারতের বাজারে ১২৮ কোটি (১.২৮ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেন। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১২৫ কোটি (১.২৫ বিলিয়ন) ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা কমে ১০৯ কোটি ৬২ লাখ (১.০৯ বিলিয়ন) ডলারে নেমে আসে।

বাংলাদেশ ভারতে মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি করে থাকে। এছাড়া কাঁচা পাট ও পাটজাতপণ্য, সুতা, প্লাস্টিক পণ্য এবং চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে।

গত অর্থ বছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে ৫৫ কোটি ডলার, পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে ২২ কোটি ডলার এবং চামড়া থেকে ১১ কোটি ডলার আয় এসেছিল।

ভবিষ্যৎ কী

কোভিড মহামারীর সময় সারাবিশ্বে যোগাযোগ থমকে গেলে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য বাড়তে শুরু করে। কারণ অন্য দেশে বাধা থাকায় দুই দেশই নিজেদের উৎস থেকে লেনদেন বাড়াচ্ছিল। আবার দু্ই দেশের পরিবহণ যোগাযোগ বাড়াও এতে প্রভাব ফেলে।

এবার শুরুতে বাড়তে থাকার ধারা দেখা দিলেও রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হলে তা ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।

তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “দিন যত যাচ্ছে, সম্পর্ক খারাপের দিকেই যাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি বাড়বে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।”

ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করেন সেলিম রায়হান। সেজন্য রপ্তানিকারকদের সক্ষমতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন তিনি।

সেলিম রায়হান বলেন, “ভারতের বাজারে অনেক সময় অযৌক্তিকভাবে অশুল্ক বাধা আরোপ করা হয়। এই বাধা দূর করার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রপ্তানিকারকদের নেগোসিয়েশন দক্ষতা বাড়াতে হবে।”

তবে এখন সম্পর্কের অবনতি ঘটলে কূটনৈতিক উদ্যোগও স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, সম্পর্ক ভালো থাকলে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব।

তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। দেড়শ’ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে। ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনবে।”

ভারতের বাজারে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে তা যেন নষ্ট হয়ে না যায়, তা চাইছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমাদের তৈরি পোশাকের খুবই সম্ভাবনা এবং ভালো বাজার হয়ে উঠছিল ভারত। সার্বিক রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাঝে হোঁচট খেয়েছিল।

“এখন আবার বাড়ছে। এটা ধরে রাখতে হবে। সেজন্য কুটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে সম্পর্ক দেখা দিয়েছে, তার সম্মানজনক সমাধান করতে হবে।”

“মনে রাখতে হবে, পাশের দেশ হওয়ায় ভারতে পণ্য রপ্তানি করতে আমাদের পরিবহন খরচ অনেক কম হয়। স্থলবন্দর দিয়েই সব পণ্য রপ্তানি হয়। সে কারণে ভারতে আমাদের রপ্তানি যত বাড়বে, ততই ভালো,” বলেন হাতেম।

টানা দুই মাস ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় পরবর্তী

টানা দুই মাস ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয়

কমেন্ট