যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমছে, বাড়ছে ভিয়েতনাম ভারত পাকিস্তানের
চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৬১৪ কোটি ৬০ লাখ (৬.১৪ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম।
দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পে অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে। একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশটি থেকে।
উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে, এই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমছে, প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনামের রপ্তানি বাড়ছে; ভারত, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানেরও বেড়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে অর্থাৎ জানুয়ারি-অক্টোবর সময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৬১৪ কোটি ৬০ লাখ (৬.১৪ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ কম।
২০২৩ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়ে এই বাজারে ৬৩৫ কোটি ৮০ লাখ (৬.৩৬ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিলেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
অথচ এই দশ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। কম্বোডিয়ার বেড়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ। পাকিস্তানের বেড়েছে ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ। ভারতের বেড়েছে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৬ হাজার ৭০৪ কোটি ৬০ লাখ (৬৭.০৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছেন। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় দশমিক ৩৩ শতাংশ কম।
২০২২ সালে আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। কিন্তু গত বছর প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো ২৫ শতাংশ কমেছিল। সেই নেতিবাচক ধারা চলতি বছরেরও অব্যাহত রয়েছে।
এই তথ্য বলছে, বড় এই বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে কমছে। অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন, ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান ও শ্রমিক অসন্তোষের কারণে পোশাক খাতের উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারও একটা প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে।
এমন পরিস্থিতে পোশাক শিল্পমালিকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকারের চার মাস পার হয়েছে। কিন্তু এখনও দেশের পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়বে—এমনটা আশা করতে পারছেন না তারা। উল্টো আরও কমে যেতে পারে—এই শঙ্কায় আছেন তারা।
শেখ হাসিনা সরকার পতন আন্দোলনকে ঘিরে জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময় থেকে আন্দোলন সংঘাতে দেশে উৎপাদন ব্যাহত হয়। ৫ অগাস্ট সরকার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়।
এর মধ্যে গাজীপুর ও ঢাকার সাভারে শ্রমিক অসন্তোষের বেশ কয়েক দিন অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ থাকে; উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়।
পোশাক শিল্পমালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ গত ১৯ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে অন্তত ৪০ কোটি ডলারের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার (প্রতি ডলার ১২০ টাকা) হিসাবে টাকার অঙ্কে ওই অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “সামগ্রিকভাবে বলা যায়, বড় ধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। চার মাস হয়ে গেলো নতুন সরকার এসেছে। তার পরও কোনো কিছু স্বাভাবিক হচ্ছে না। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই।। দিন যতো যাচ্ছে—পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে।”
“এমন পরিস্থিতিতে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা খুবই কঠিন হবে। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে সব দেশের রপ্তানি কমেছিল। কিন্তু এ বছর প্রায় সব দেশই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমাদের কমেছে। এর প্রধান কারণ অস্থিরতা। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর যে অস্থিরতা শুরু হয়েছিল, তা এখনও রয়ে গেছে। এর উন্নতি না হলে যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য দেশেও আমাদের পোশাক রপ্তানি কমে যাবে।”
“বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়বো আমরা,” বলেন পারভেজ।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, বলছেন, “জুলাই-অগাস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সামগ্রিক রপ্তানিতে এখনও প্রবৃদ্ধি থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে যাওয়ায় আমরা চিন্তার মধ্যে আছি। যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার এসেছে। জানি না, ভবিষ্যতে কি হবে।”
তিনি বলেন, “চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গিয়েছে। আমাদের হিসাবে জুলাই মাসের মধ্যে এক সপ্তাহেই পোশাক শিল্পে ক্ষতি হয়েছে ১ বিলিয়নের উপর। আর ব্যাংক বন্ধ থাকায় তো রপ্তানির উপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।”
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে। ওই বছরের জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ১ শতাংশে দাঁড়ায়। মূল্যস্ফীতি ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছানোর কারণে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্য পণ্য কেনাকাটা কমিয়ে দেন ভোক্তারা।
দেশটি বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমে। তারপরও গত বছর দেশটিতে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ১ শতাংশ। সে কারণে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকেরা তার আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ কম তৈরি পোশাক আমদানি করে। ফলে শীর্ষ পাঁচ রপ্তানিকারক দেশের পোশাক রপ্তানি ২১ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
অটেক্সার তথ্যে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যখন কমছে, তখন একাধিক প্রতিযোগী দেশ ভালো করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানিকারক ভিয়েতনাম। চলতি বছরের দশ মাসে ১ হাজার ২৭০ কোটি ৪০ লাখ (১২.৭০ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে দেশটি। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তাদের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৪ শতাংশ। বর্তমানে বাজারটির ১৯ শতাংশ ভিয়েতনামের দখলে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের পোশাক রপ্তানি গত বছর ২১ শতাংশ কমেছিল। চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দেশটির রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক (নেগেটিভ) ছিল। সেপ্টেম্বরের থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরের প্রথম দশ মাসে ৪০৫ কোটি ১০ লাখ (৪.০৫ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে ভারত; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এই বাজারে ভারত পঞ্চম শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ।
একইভাবে কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানের পোশাক রপ্তানিও বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চলতি বছরের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়ে কম্বোডিয়া ৩২২ কোটি ৪০ লাখ (৩.২২ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১২ দশমিক ৯১ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে চলতি বছরের এই দশ মাসে পাকিস্তান রপ্তানি করেছে ১৭৯ কোটি ৯০ লাখ (১.৮ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক। তাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে শীর্ষস্থান ধরে রাখলেও চীন ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি এখনও। বর্তমানে চীন এই বাজারের ২১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে। চলতি বছরের জানুয়ারি-অক্টোবর সময়ে ১ হাজার ৪০৩ কোটি ২০ লাখ (১৪.০৩ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে দেশটি। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ০৬ শতাংশ কম।
আর বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজার হিস্যার ৯ দশমিক ১৬ শতাংশ দখলে নিয়ে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ।
কমেন্ট