ট্রাম্পের শুল্ক বাংলাদেশের ‘সুবর্ণ সুযোগ’

ট্রাম্পের শুল্ক বাংলাদেশের ‘সুবর্ণ সুযোগ’

এই বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৪৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি।

একক দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির এই দেশ থেকে।

অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২২ সালে এই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো ২৫ শতাংশ কমেছিল।

সেই নেতিবাচক ধারা চলে ২০২৪ সালেও। তবে বছরের শেষ দিকে এসে গতি বাড়ায় শেষ পর্যন্ত নামমাত্র প্রবৃদ্ধি দিয়ে শেষ হয়েছিল বছর। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে, যা ছিল ২০২৩ সালের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।

সুসংবাদ হচ্ছে নতুন বছর অর্থাৎ ২০২৫ সাল শুরু হয়েছে বড় চমক দিয়ে। এই বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের জানুয়ারির চেয়ে ৪৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেশি। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ৫৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল দেশটিতে।

প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ধারেকাছেও নেই প্রতিযোগী দেশ চীন, ভিয়েতনাম, ভারতসহ অন্য কোনও দেশ। এরই মধ্যে আরেকটি সুবর্ণ সুযোগ এসেছে বাংলাদেশের জন্য।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় বাজারটি নিয়ে নতুন সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।

এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বর্তমানের চেয়ে আর ২৫ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা।

ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে গত জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকেরা ৭২০ কোটি (৭.২০ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছেন। গত বছরের জানুয়ারিতে তারা আমদানি করেন ৬০৩ কোটি (৬.০৩) ডলারের পোশাক।

হিসাব বলছে, নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাক আমদানি বেড়েছে ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

এই পরিসংখ্যান বলছে, অনেক দিন পর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে ভালোভাবে ঘুরে দাঁড়াল বাংলাদেশ। এ বাজারে গত বছর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশ। ২০২৪ সাল শেষে বড় প্রবৃদ্ধি না হলেও ইতিবাচক ধারায় ফেরে।

সব মিলিয়ে গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই রপ্তানি ২০২৩ সালের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি ২৫ শতাংশ কমে ৭২৯ কোটি (৭.২৯ বিলিয়ন) ডলারে নেমেছিল।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করেন।

এর ফলে বাজারটি নিয়ে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা।

তারা বলছেন, চীনা পণ্যে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে। এতে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রয়াদেশ সরাবে। ফলে বাড়তি ক্রয়াদেশ বা অর্ডার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে বাংলাদেশের জন্য। এমনকি বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে কারখানা সরিয়ে এখন অন্য দেশে নিতে আগ্রহী হতে পারেন। বিনিয়োগের সেই সুযোগ বাংলাদেশও নিতে পারে।

অবশ্য বর্তমানে পোশাক রপ্তানিতে যে প্রবৃদ্ধি, তা মূলত দেশটির অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোয় বাড়তি ক্রয়াদেশের প্রভাব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৬০ কোটি (১.৬০ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে চীন। এ রপ্তানি গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় ১৩ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি। ওই মাসে ভিয়েতনাম রপ্তানি করেছে ১৪৪ কোটি (১.৪৪ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই মাসের তুলনায় ১৯ দশমিক ৯০ শতাংশ বেশি।

অন্য দেশগুলোর মধ্যে জানুয়ারিতে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৪৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে; প্রবৃদ্ধি হয় ৩৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। মেক্সিকো রপ্তানি করেছে ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ডলারের পোশাক; প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। কম্বোডিয়া রপ্তানি করেছে ৩২ কোটি ৪৫ লাখ ডলারের পোশাক; প্রবৃদ্ধি ২৯ দশমিক ৯৫ শতাংশ।

পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭ দশমিক ৫০ শতাংশ; রপ্তানি করেছে ১৭ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের পোশাক।

নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে এই উল্লম্ফনে খুবই খুশি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা। আগামী দিনগুলোতে এই বাজারে রপ্তানি আরও বাড়ার ‘সুবর্ণ সুযোগ’ দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আমরা নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর অনেক পোশাক কারখানায় হামলা-ভাঙচুর করা হয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস সঙ্কট লেগেই আছে। দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এর মধ্যেও আমাদের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে ৪৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি খুবই ভালো একটা খবর।”

“এই রপ্তানি আরও বাড়ানো সম্ভব, আমাদের সামনে সুবর্ণ সুযোগ এসেছে” মন্তব্য করে হাতেম বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডা, মেক্সিকো ও চীন থেকে পণ্য আমদানিতে বাড়তি শুল্ক আরোপ করায় বাজারটি নিয়ে নতুন করে সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগ যদি আমরা কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের রপ্তানি ২৫ শতাংশ বাড়বে।”

তিনি বলেন, “চীন আমাদের প্রধান প্রতিযোগী। চীনা পণ্যে অতিরিক্ত শুল্ক বসানোর ফলে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রয়াদেশ সরাবে। ফলে বাড়তি ক্রয়াদেশ বা অর্ডার পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে কিছু অর্ডার পাচ্ছিও। এমনকি বিনিয়োগকারীরা চীন থেকে কারখানা সরিয়ে এখন অন্য দেশে নিতে আগ্রহী হতে পারেন। বিনিয়োগের সেই সুযোগ বাংলাদেশও নিতে পারে।

“আমাদের এখন এই সুযোগটিই কাজে লাগাতে হবে। আর এ জন্য সরকার ও পোশাক শিল্পমালিক ও রপ্তানিকারকদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। জরুরি সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত নিতে হবে। কোনও ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা থাকলে চলবে না।”

একই কথা বলেছেন পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।

এআরএইচ ডট নিউজকে তিনি বলেন, “বড় ধরনের অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। আট মাস হয়ে গেলো নতুন সরকার এসেছে। তারপরও কোনও কিছু স্বাভাবিক হচ্ছে না। সর্বত্র অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা; কোথাও স্বস্তি নেই। দিন যতো যাচ্ছে, পরিস্থিতি ততোই খারাপের দিকে যাচ্ছে।

“এ সবের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি বাড়া আমাদেরকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিচ্ছে। এই বাজার আরও ভালোভাবে দখলের একটা সুযোগ এসেছে। এই সুযোগটাই এখন আমাদের সবাই মিলে কাজে লাগাতে হবে।”

এজন্য সবার আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রততার সঙ্গে স্বাভাবিক করতে হবে বলে মনে করেন আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।

তিনি বলেন, “তা না হলে বায়ারদের আস্থা পাওয়া যাবে না। চীনের উপর বাড়তি শুল্ক আরোপের কারণে যে সুযোগ এসেছে সেটাও ভোগ করতে পারবো না।”

রপ্তানি আয়ে ধীরগতি, ৫ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম ফেব্রুয়ারিতে পরবর্তী

রপ্তানি আয়ে ধীরগতি, ৫ মাসের মধ্যে সবচেয়ে কম ফেব্রুয়ারিতে

কমেন্ট