বৈরি সম্পর্কের মধ্যেও ভারতে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়েছে
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েনের প্রভাব পড়েনি বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে। ভারত থেকে পণ্য আসা যেমন কমেনি; তেমনি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি তো কমেইনি, বরং বাড়ছে।
রাজনৈতিক সম্পর্কে বৈরিতার মধ্যেও ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে। এই বৃদ্ধির হার তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকেও ছাড়িয়ে গেছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) পাশের দেশটিতে ১২৫ কোটি ১৭ লাখ (১.২৫ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ তথ্যের সঙ্গে আগের তথ্যের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, এই অঙ্ক গত অর্থ বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি।
এই প্রবৃদ্ধি অপ্রচলিত বা নতুন বাজারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি; একক বাজার হিসাবে সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমান। অন্য বড় বাজার জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডার চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে এই খাত থেকে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থ বছরের আট মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ভারতের বাজারে; ১৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, কানাডা, ফ্রান্স— এ সব বড় বাজারের চেয়েও ভারতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে বেশি প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এই আট মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এই সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। জার্মানি, যুক্তরাজ্য, স্পেন ও কানাডার বাজারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ১০ দশমিক ৮৬, ৩ দশমিক ৩২, ৬ দশমিক ৭২ এবং ১২ দশমিক ৫১ শতাংশ।
অপ্রচলিত বাজারের মধ্যে জাপানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৭২ শতাংশ। অষ্ট্রেলিয়ায় বেড়েছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। তুরস্কে বেড়েছে ১০ দশমিক ৯৮ শতাংশ। চীনে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৯১ শতাংশ।
বিপরীতে রাশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়াসহ অন্য দেশগুলোতে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। রাশিয়ায় কমেছে সবচেয়ে বেশি ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ।
ইপিবির এই তথ্যই বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর কূটনৈতিক সম্পর্কে টানাপড়েনের প্রভাব পড়েনি বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যে। ভারত থেকে পণ্য আসা যেমন কমেনি; তেমনি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি তো কমেইনি, বরং বাড়ছে।
তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ রপ্তানি বাড়ানোর জন্য কূটনৈতিক সম্পর্ক ভালো করার ওপর জোর দিচ্ছেন।
তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “ভারতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কদর বাড়ছে। দেড়শ’ কোটি লোকের চাহিদা মেটাতে ভারতকে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কিনতেই হবে।
“ভারতে পোশাক তৈরি করতে যে খরচ হয়, বাংলাদেশ থেকে আমদানি করলে তার চেয়ে অনেক কম পড়ে। সে কারণে সব হিসাব-নিকাশ করেই তারা এখন বাংলাদেশ থেকে বেশি করে পোশাক কিনবে।”
ভারতের বাজারে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক কারণে তা যেন নষ্ট হয়ে না যায়, তা চাইছেন পোশাক ব্যবসায়ীরা।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমাদের তৈরি পোশাকের খুবই সম্ভাবনা এবং ভালো বাজার হয়ে উঠছে ভারত। সার্বিক রপ্তানি ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাঝে হোঁচট খেয়েছিল।
“এখন আবার বাড়ছে। এটা ধরে রাখতে হবে। সেজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে সম্পর্ক দেখা দিয়েছে, তার সম্মানজনক সমাধান করতে হবে।”
বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ভারতের সঙ্গে ৩৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশ যত পণ্য আমদানি করে তার অনেক কমই রপ্তানি করে থাকে।
কোভিড মহামারির সময় সারাবিশ্বে যোগাযোগ থমকে গেলে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য বাড়তে শুরু করে।
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে ২১৩ কোটি (২.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। ভারতে রপ্তানি করে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় বাংলাদেশের সেটাই প্রথম।
তবে পরের অর্থ বছরে সেই রপ্তানিতে ভাটা পড়ে; আয় নেমে আসে ১৫৬ কোটি ৯২ লাখ (১.৫৭ বিলিয়ন) ডলারে। এরপর আবার ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।
২০২৩-২৪ অর্থ বছরের প্রথম আট মাসে ভারতে রপ্তানি করে যেখানে ১০৮ কোটি ৮৮ লাখ (১.০৮ বিলিয়ন) ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ; সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের একই সময়ে রপ্তানি ১২৫ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে ভারতে রপ্তানি বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৪ শতাংশ।
এই আয়ের মধ্যে ৪৭ কোটি ৮২ লাখ ডলার এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। পাট ও পাটজাতপণ্য রপ্তানি থেকে এসেছে ১২ কোটি ৯৯ লাখ ৩০ হাজার ডলার। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে এসেছে ৭ কোটি ৪ লাখ ডলার। প্লাস্টিক দ্রব্য থেকে এসেছে ৪ কোটি ৫২ লাখ ডলার এবং সুতাজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে এসেছে ২ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার ডলার।
বৈরী সম্পর্কের মধ্যে ভারতের পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের বাণিজ্যের জন্য ভালো দিক হিসাবে দেখালেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক মোটেই ভালো যাচ্ছে না। এটা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে কিন্তু আগামী দিনগুলোতে রপ্তানি বাড়বে কি না, তা নিয়ে সংশয় তো থাকছেই।
সেলিম রায়হান যুক্তরাষ্ট্র-চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের দিকটি দেখিয়ে বলেন, “দুদেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্ক বেশি দিন ধরে খারাপ থাকলে তার প্রভাব আমদানি-রপ্তানি বা ব্যবসা-বাণিজ্যেও পড়বে। হঠাৎ করে বাড়তি শুল্ক আরোপ হতে পারে। যেমনটি এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে হচ্ছে।”
কমেন্ট