যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানি: আশায় বছর শুরুর পর এখন নিরাশা
আগামী বুধবার নতুন শুল্কহার কার্যকরের কথা। তার মধ্যেই ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখা কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের কাছ থেকে বিভিন্ন রপ্তানিকারকদের কাছে চিঠি আসা শুরু হয়েছে।
ট্রাম্প শুল্কের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে; যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ স্থগিতের নির্দেশনা আসতে শুরু করেছে।
অথচ বছরের শুরুতেও এমনটা ভাবেননি বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিকারকরা। কারণ ২০২৫ সালের শুরুটা হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের উল্লম্ফন দিয়ে।
গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ১৫০ কোটি (১.৫০ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের, যা গত বছরের এই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।
তা দেখে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মালিকরা বেজায় খুশি হয়ে ব্যবসা আরও বাড়ার আশা যখন করছিলেন। হিসাব কষে দেখছিলেন, এবছর যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি ২৫ শতাংশ বাড়বে।
ঠিক তখনই আঘাত হয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্য নীতি। গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের পণ্যে পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন তিনি। তাতে বাংলাদেশের পণ্যে যোগ হয় ৩৭ শতাংশ শুল্ক। আগের ১৫ শতাংশের সঙ্গে মিলে সর্বমোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ৫২ শতাংশ।
আগামী বুধবার নতুন শুল্কহার কার্যকরের কথা। তার মধ্যেই ক্রয়াদেশ স্থগিত রাখা কথা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকদের কাছ থেকে বিভিন্ন রপ্তানিকারকদের কাছে চিঠি আসা শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা বাড়তি শুল্কের লোকসান কমাতে মূল্যছাড় চাইছে।
শনি ও রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি শেষে প্রতিক্রিয়া আসা শুরু হয়েছে। সপ্তাহ শেষে প্রকৃত পরিস্থিতি বোঝা যাবে।
সার্বিক পরিস্থিতি এখনও বুঝতে না পারলেও বিপদ যে ঘনিয়ে আসছে, তা উপলব্ধি করতে পারছেন ইভিন্স গ্রুপের কর্ণধার আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ।
তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমাদের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেছে। তালগোল পাকিয়ে গেছে সবকিছু। কী হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না।”
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শীর্ষ রপ্তানিকারকদের একটি ইভিন্স গ্রুপ। এর মালিক পারভেজ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সবচেয়ে বড় সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি।
বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক। মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর একক দেশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র এর সবচেয়ে বড় বাজার।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৩৬ শতাংশ বেড়ে ৯৭৩ কোটি (৯.৭৩ বিলিয়ন) ডলারে উঠেছিল। তবে পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তা ২৫ শতাংশ কমে যায়।
সেই নেতিবাচক ধারা চলে ২০২৪ সালেও। তবে বছরের শেষ দিকে এসে গতি বাড়ায় শেষ পর্যন্ত নামমাত্র প্রবৃদ্ধি দিয়ে শেষ হয়েছিল বছর। গত বছর বাংলাদেশ থেকে ৭৩৪ কোটি (৭.৩৪ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, যা ছিল ২০২৩ সালের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
নতুন বছর অর্থাৎ ২০২৫ সাল শুরু হয়েছিল বড় চমক দিয়ে। এই বছরের প্রথম মাসে (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১৫০ কোটি (১.৫০ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।
দুই মাসের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ধারেকাছেও ছিল না প্রধান দুই প্রতিযোগী দেশ চীন ও ভিয়েতনাম। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২৭৭ কোটি (২.৭৭ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করে চীন; ভিয়েতনাম করে ২৬২ কোটি (২.৬২ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক।
তবে মোট পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের ঠিক পরের অবস্থানে (চতুর্থ) থাকা ভারতের প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের প্রায় কাছাকাছি, ২৫ দশমিক ৭০ শতাংশ। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি সময়ে ভারত যুক্তরাষ্ট্রে ৯৫ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে।
ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ তথ্যানুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের আমদানি করা মোট তৈরি পোশাকের প্রায় ১০ বর্তমানে বাংলাদেশের দখলে রয়েছে।
চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে ১ হাজার ৩৫৫ কোটি (১৩.৫৫ বিলিয়ন) ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।
গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ১০ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিই সবচেয়ে বেশি। তবে এই উচ্চ প্রবৃদ্ধি সামনের দিনগুলোতে থাকবে কি না, তা নিয়েই এখন সংশয়।
দুশ্চিন্তায় থাকা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগামী গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ থেকেই নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, উচ্চ শুল্কের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের চাহিদা কমবে। আবার শুল্কের কারণে খরচ কমাতে দীর্ঘ মেয়াদে এক দেশ থেকে অন্য দেশে ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করতে পারেন ক্রেতারা।
সব মিলিয়ে নতুন শুল্ক আরোপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে সংকট তৈরি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলো হচ্ছে চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, মেক্সিকো, হন্ডুরাস, কম্বোডিয়া, পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়া।
ট্রাম্প চীনা পণ্যে ৩৪ (মোট শুল্ক ৫৪ শতাংশ), ভিয়েতনামের পণ্যে ৪৬, ভারতীয় পণ্যে ২৬, ইন্দোনেশিয়ার পণ্যে ৩২, হন্ডুরাসের পণ্যে ১০ শতাংশ, কম্বোডিয়ার পণ্যে ৪৯, পাকিস্তানি পণ্যে ২৯ ও দক্ষিণ কোরিয়ার পণ্যে ১৭ শতাংশ হারে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন।
ভারতের পণ্যে শুল্ক তুলনামূলক কম আরোপ হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে ক্রয়াদেশ প্রতিবেশী দেশটিতে চলে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও রপ্তানিকারকদের।
সেটা নিয়েও চিন্তিত বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি পারভেজ। কারণ তিনি দেখছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে এখন বাংলাদেশকে টপকে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে ভারতের।
ভারতের পণ্যের ওপর আগে যুক্তরাষ্ট্রে আড়াই শতাংশ শুল্ক বসানো ছিল। এখন তার সঙ্গে ২৬ শতাংশ যোগ হলে সব মিলিয়ে দাঁড়াবে ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়ে যাচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ, ৫২ শতাংশ।
পারভেজ বলেন, “এটা তো নিশ্চিত যে এই শুল্ক আমাদের রপ্তানির ওপর বড় প্রভাব ফেলবে। এখন কতটা পড়বে, তা নিয়েই আতঙ্কিত আমরা।”
পোশাক রপ্তানিকারকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমও এখন ক্রয়াদেশ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “যেসব ক্রয়াদেশের পণ্য উৎপাদনের অপেক্ষায় রয়েছে, সেগুলোর জাহাজীকরণ পাল্টা শুল্কের কারণে পিছিয়ে কিংবা স্থগিত করে দিতে পারেন ক্রেতারা। আবার যেসব ক্রয়াদেশ চূড়ান্ত করার অবস্থায় রয়েছে, সেগুলোর একটা অংশও সরিয়ে নিতে পারেন তারা।”
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা যেমন দুশ্চিন্তায়, তেমনি সার্বিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারেরও শঙ্কার কারণ রয়েছে। কারণ বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য হচ্ছে এই তৈরি পোশাক। সঙ্কটের মধ্যে এই খাতই ডলারের জোগানের বড় উৎস।
ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বিভিন্ন দেশে মোট ৩ হাজার ২৯৪ কোটি ২৬ লাখ (৩২.৯৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য রপ্তানির ৮১ দশমিক ৩৪ শতাংশই এসেছে তৈরি পোশাক থেকে।
আর যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৮৪০ কোটি ডলার বা বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় এক লাখ এক হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে পোশাক থেকে আয় হয় ৮৮ হাজার ৪০২ কোটি টাকা।
ট্রাম্প যেহেতু যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বেশি, সেসব দেশের পর শুল্ক বেশি চড়িয়েছেন, তাই তার মন গলাতে ওই দেশের পণ্য বাংলাদেশে ঢোকার ক্ষেত্রে শুল্ক কমানোর সুপারিশ করছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
অন্তর্বর্তী সরকার এরই মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক করেছে। বৈঠকে ব্যবসায়ী নেতাদেরও ডাকা হয়েছে, তাদের পরামর্শ শোনা হয়েছে।
এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিতের অনুরোধ জানিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে প্রধান উপদেষ্টা চিঠি দিয়েছেন বলে সোমবার জানিয়েছেন তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
একটি চিঠি দেওয়া হবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। আরেকটি চিঠি দেওয়া হবে বাণিজ্য উপদেষ্টার পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর ইউএসটিআরকে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, তারা পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে কর্মপরিকল্পনা নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা করেছেন। তাতে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অশুল্ক বাধা দূর করার বিষয়টিতেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
কমেন্ট