ইউরোপেও বাংলাদেশের পোশাকের বাজিমাত

ইউরোপেও বাংলাদেশের পোশাকের বাজিমাত

বড় বড় বাজারে রপ্তানি বাড়ায় পোশাক রপ্তানিকারকরা খুশি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্য নীতির ধাক্কায় শেষ পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে।

নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপের বাজারে পোশাক রপ্তানিতে চমক দেখিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) ইউরোপের বাজার থেকে প্রায় ৬ বিলিয়ন (৬০০ কোটি) ডলার আয় করেছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ শতাংশ বেশি।

তিন মাসের প্রবৃদ্ধিতে বাংলাদেশের ধারেকাছেও নেই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীন; এই তিন মাসে চীন ইউরোপের বাজারে ৬৬৭ কোটি ২২ লাখ (৬.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে; রপ্তানির অঙ্ক বড় হলেও তাদের প্রবৃদ্ধি ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ।

বড় বড় বাজারে রপ্তানি বাড়ায় পোশাক রপ্তানিকারকরা খুশি হলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নতুন বাণিজ্য নীতির ধাক্কায় শেষ পরিণতি কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কাও রয়েছে।

২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার। পোশাক রপ্তানি থেকে মোট যে আয় হয়, তার প্রায় ৬০ শতাংশ আসে এই বাজার থেকে।

অভ্যুত্থানে রাষ্ট্র ক্ষমতার পরিবর্তনের পর শ্রমিক অসন্তোষে কারখানা বন্ধসহ নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তার মধ্যে গত বছরের শেষ দিকে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেশ কমে গিয়েছিল।

২০২৪ সালের নয় মাস (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক (-২ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ) হয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে ইউরাপের বাজারে পোশাক রপ্তানি করে ২০২৩ সালের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ কম আয় হয়েছিল।

তবে বছরের শেষ তিন মাসে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) রপ্তানি বাড়ায় শেষ পর্যন্ত ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে শেষ হয়েছিল বছর।

২০২৪ সালে ইউরোপের দেশগুলোতে মোট ১ হাজার ৯৭৭ কোটি ১২ লাখ (১৯.৭৭ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল। আগের বছরে অর্থাৎ ২০২৩ সালে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ১ হাজার ৮৮৫ কোটি ৫৭ লাখ (১৮.৮৫ বিলিয়ন) ডলার।

২০২৫ সাল শুরু হয়েছে বড় চমক নিয়ে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান অফিসের (ইউরোস্ট্যাট) সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ৫৯৭ কোটি ৬১ লাখ (৫.৯৮ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৯ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ বেশি।

এর আগে তিন মাসে কখনই এত প্রবৃদ্ধি দেখা যায়নি এই বাজারে। প্রধান প্রতিযোগী দেশ চীন, ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধির ধারেকাছেও নেই।

২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে এই বাজারে ৪৬৩ কোটি ৫ লাখ (৪.৬৩ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছিল।

ইইউতে রপ্তানি কার কত

সোমবার প্রকাশিত ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম তিন মাসে ইইউর কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ২ হাজার ৪৬৫ কোটি ২১ লাখ (২৪.৬৫ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে। এই আমদানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ বেশি।

ইইউতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীন সবার শীর্ষে। তৃতীয় তুরস্ক।

জানুয়ারি-মার্চ সময়ে চীন ইউরোপের বাজারে ৬৬৭ কোটি ২২ লাখ (৬.৬৭ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে; যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি।

২০২৪ সালের এই তিন মাসে চীনের রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৫ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার।

তবে এই বাজারে তুরস্কের রপ্তানি কমেছে; ৪ দশমিক ১৪ শতাংশ নেতিবাচক (ঋণাত্মক বা নেগেটিভ) প্রবৃদ্ধি হয়েছে। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে তুরস্ক ইউরোপে ২৩৬ কোটি ৯৬ লাখ (২.৩৭ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে।

২০২৪ সালের এই তিন মাসে রপ্তানির অঙ্ক ছিল ২ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার।

ইউরোপে পোশাক রপ্তানিতে চতুর্থ স্থানে রয়েছে ভারত। জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ভারত ইউরোপের বাজারে ১৪৪ কোটি ৪২ লাখ (১.৪৪ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৪ শতাংশ।

কম্বোডিয়ার প্রবৃদ্ধি হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৩৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এই তিন মাসে দেশটি ইউরোপে ১১৬ কোটি ৩৬ লাখ (১.১৬ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে তাদের রপ্তানির অঙ্ক ছিল ৮৭ কোটি ১৯ লাখ ডলার।

অন্য দেশগুলোর মধ্যে জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮ দশমিক শূন্য নয় শতাংশ; রপ্তানি হয়েছে ১১৩ কোটি ৭৫ লাখ (১.১৩ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক।

পাকিস্তানের রপ্তানির অঙ্ক ১০৮ কোটি ৪৬ লাখ (১.০৮ বিলিয়ন) ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

এছাড়া জানুয়ারি-মার্চ সময়ে ইউরোপের বাজারে শ্রীলঙ্কার রপ্তানি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ার ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং মরক্কোর প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ১৮ শতাংশ।

২০২৪ সালে ইউরোপের কোম্পানিগুলো বিভিন্ন দেশ থেকে ৯২ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছিল, যা ছিল ২০২৩ সালের চেয়ে ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি।

গত বছর চীন ইউরোপের বাজারে ২৬ দশমিক শূন্য সাত বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছিল; যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ২ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।

তবে গত বছর এই বাজারে তুরস্কের রপ্তানি বেশ খানিকটা কমেছিল; ৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ার কমেছিল ৫ দশমিক ৮১ শতাংশ।

ভারতের বেড়েছিল প্রায় ২ শতাংশ। কম্বোডিয়ার বেড়েছিল ২০ দশমিক ৭৩ শতাংশ।

অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনামের বেড়েছিল ৪ দশমিক ২১ শতাংশ। পাকিস্তানের বেড়েছিল ১২ দশমিক ৪১ শতাংশ। মরক্কোর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

আশার সঙ্গে শঙ্কা

অস্থিরতার মধ্যেও ইউরোপের বাজারে পোশাক রপ্তানি বাড়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম।

তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “জুলাই-অগাস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এরপরও রপ্তানি আয় বাড়ায় আমরা খুশি। ২০২৫ সালটা ভালোই শুরু হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

“অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আমরা নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর অনেক পোশাক কারখানায় হামলা-ভাংচুর করা হয়েছে। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গ্যাস সঙ্কট লেগেই আছে। অস্থিরতা-অনিশ্চয়তা না থাকলে আমাদের রপ্তানি আরও বাড়ত।”

তবে এই ধারা টেকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে হাতেম বলেন, “জানি না আগামী মাসগুলোতে কী হবে? বিশ্বজুড়ে রীতিমতো বাণিজ্য যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়ে ঝড় তুলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এটার পরিণতি কী হবে, তা আমরা পরিষ্কার কিছুই বুঝতে পারছি না।”

যদিও ট্রাম্প তার প্রথম সিদ্ধান্ত থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। চীন ছাড়া অন্য সব দেশের জন্য ধার্য করা যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক ৯০ দিন স্থগিত করা হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের পণ্যের ওপরও আরোপিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক স্থগিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক সমস্যার ভালো একটি সমাধান হলে ২০২৫ সালটা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য ভালো একটা বছর হবে বলে মনে করছেন হাতেম।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র‍্যাপিড) এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইইউর বাজারে বাংলাদেশের ৬৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব। পোশাকের বৈশ্বিক বাজারের গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে এই পরিসংখ্যান দিয়েছে র‍্যাপিড।

বর্তমান অবস্থায়ও ইইউতে বাড়তি ১৮ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বলে মনে করে র‍্যাপিড।

ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (অটেক্সা) হালনাগাদ তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রে ২২২ কোটি ৩৯ লাখ (২.২২ বিলিয়ন) ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি।

পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ চেম্বারের বর্তমান সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজও ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ী।

তিনি এআরএইচ ডট নিউজকে বলেন, “আমরা চিন্তিত এখন আগামী দিনগুলো কী হয়, তা নিয়ে। তিন মাস স্থগিত থাকায় এখনও ট্রাম্প শুল্কের প্রভাব পুরোপুরি পড়েনি। চলতি মে মাসেও হয়ত তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে জুন মাস থেকে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে শুরু করবে।

“বর্তমানের ১০ শতাংশ যে বাড়তি শুল্ক আছে, সেটাও যদি বহাল থাকে, তারপরও আমাদের অনেক ক্ষতি হবে।”

স্থলপথে পণ্য নেবে না ভারত: রপ্তানি কতোটা কমবে পরবর্তী

স্থলপথে পণ্য নেবে না ভারত: রপ্তানি কতোটা কমবে

কমেন্ট