আমদানি কমায় বাণিজ্য ঘাটতি অর্ধেকে নেমেছে
চট্টগ্রাম বন্দর। ফাইল ছবি
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় বেশ কমেছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। আর এতে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে। বাণিজ্য ঘাটতি অর্ধেকে নেমে এসেছে।
আর এতে কমেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন (৩৭৭ কোটি ২০ লাখ) ডলার।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল তিন গুণ বেশি ১৫ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি।
তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সূচকে ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, ‘সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে পণ্য আমদানি ব্যয় কমেছে। সে কারণে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমেছে। এটা ভালো দিক। তবে ডলারসংকট কিন্তু কাটেনি। এখনো রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।”
“এখন প্রশ্ন হচ্ছে-রিজার্ভ আর কত কমবে? রিজার্ভ যাতে আর না কমে, সেদিকে এখন সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। আর সে কারণে রপ্তানি আয়ের ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে হবে। রেমিট্যান্স আরও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ অন্য দাতা সংস্থার ঋণগুলোর ঋণ যাতে দ্রুত পাওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল; ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।
এখন আমদানি ব্যয়ে ধীরগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ। আর রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ।
গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে অর্থনীতির বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, ‘ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমে এলে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, রিজার্ভ না বাড়লে কিন্তু ডলারের দাম কমবে না। তাই রিজার্ভ বাড়ানোর দিকেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দিতে হবে সরকারকে।”
“আমদানি ব্যয় কমিয়ে নয়, রেমিটেন্স, রপ্তানি আয় ও কম সুদের বিদেশি ঋণ বাড়িয়ে রিজার্ভ বাড়তে হবে,” বলেন দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা এই অর্থনীতিবিদ।
বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
বাণিজ্য ঘাটতি কমে অর্ধেকে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এই দশ মাসে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের এই দশ মাসে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ ছিল, ২৭ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার।
বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ৫৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরের এই দশ মাসে ৬৮ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে জুলাই-এপ্রিল সময়ে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৩ দশমিক শূন্য পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ দশমিক শূন্য ছয় শতাংশ বেশি। গত বছরের এই দশ মাসে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪০ দশমিক ৯৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
এ হিসাবেই বিদায়ী অর্থবছরের দশ মাসে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৭৩ বিলিয়ন ডলার।
অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
রেমিট্যান্স বেড়েছে ২.৩৭ শতাংশ
২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম।
তবে এবার এই সূচকে উল্লম্ফন নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।
কিন্তু সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। ওই দুই মাসেই দেড় বিলিয়ন ডলার করে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ প্রথম দুই মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে পাঠিয়েছিলেন।
তবে নভেম্বর থেকে রেমিট্যান্স ফের বাড়তে শুরু করেছে। নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। ডিসেম্বরেও বেড়েছে, ১৭০ কোটি ডলার এসেছে। জানুয়ারিতে এসেছে আরও বেশি ১৯৬ কোটি ডলার। ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনে হওয়ায় কম আসে, ১৫৬ কোটি ডলার।
মার্চে উল্লম্ফন হয়, আসে ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি, ২০১ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। এপ্রিল মাসে তা কমে যায়, আসে ১৬৮ কোটি ৪৯ কোটি ডলার।
সব মিলিয়ে বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে ১৭ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার দেশে এসেছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের একই সময়ে এই ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি ৮.৮ বিলিয়ন ডলার
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (ওভারঅল ব্যালান্স) বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
গত অর্থবছরের একই সময়ে এই সূচকে ৫ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি ছিল। অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে।
তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ওভারঅল ব্যালান্সে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি
আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি রয়ে গেছে। জুলাই-এপ্রিল সময়ে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের একই সময়ে ১১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত ছিল। ১৩ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল।
তার আগের অর্থবছরের ১৪ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণ-সহায়তা পাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত ছিল বলে জানান আহসান মনসুর।
কিন্তু চলতি অর্থবছরে দাতাদের ঋণ-সহায়তা বেশ কমে গেছে। জুলাই-এপ্রিল সময়ে কমেছে ২৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। সে কারণেই আর্থিক হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন মনসুর।
কমেন্ট