১১ মাসে এলসি কমেছে ২৫ শতাংশ
প্রতীকি ছবি
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বিভিন্ন পণ্য আমদানির জন্য ৬ হাজার ২৪০ কোটি (৬২.৪০ বিলিয়ন) ডলারের ঋণপত্র বা এলসি খুলেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা উদ্যোক্তারা।
এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ২৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে এই ১১ মাসে ৮৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
অন্যদিকে এলসি নিস্পত্তি কমেছে প্রায় ১০ শতাংশ। এই ১১ মাসে ৬৭ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৭৪ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি নিস্পত্তি হয়েছিল।
বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপের কারণে কমছে অর্থনীতির এই সূচক।
বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতেই আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। তার সুফলও মিলছে গত কয়েক মাস ধরে।
তার পরও রিজার্ভ বাড়ছে না। কমতে কমতে নেমে এসেছে ২৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৯ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার।
আমদানি কমায় এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয় বাড়ায় ২০২১ সালের আগস্টে এই রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
এরপর আমদানি বাড়ায় এবং রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স হোঁচট খাওয়ায় রিজার্ভ কমতে থাকে। চাপ বাড়তে থাকে অর্থনীতিতে।
সে পরিস্থিতিতে গত বছরের এপ্রিল থেকে আমদানি ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে নেয়া হয় একের পর এক পদক্ষেপ।
তাতে আমদানি খরচ বেশ কমে এসেছে। কিন্তু রিজার্ভের পতন ঠেকছে না।
বৃহস্পতিবার আমদানি সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায়, জুলাই-মে সময়ে খাদ্য (চাল ও গম) আমদানির এলসি কমেছে ১৮ দশমিক ১০ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যাপিটাল মেশিনারি (মূলধনি যন্ত্রপাতি) আমদানির এলসি কমেছে সবচেয়ে বেশি ৫৫ দশমিক ১ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ২৯ দশমিক ৪৭ শতাংশ।
শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমেডিয়েট গুডস) আমদানির এলসি কমেছে ২৪ দশমিক ৩০ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ২২ শতাংশের বেশি।
জ্বালানি তেলের এলসি কমেছে ৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ। তবে নিস্পত্তি বেড়েছে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানির এলসি কমেছে ৩০ দশমিক ১৫ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ১০ দশমিক ৮২ শতাংশ।
এছাড়া এই ১১ মাসে অন্যাণ্য পণ্য আমদানির এলসি কমেছে ২২ দশমিক ১৫ শতাংশ; নিস্পত্তি কমেছে ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
এলসি খোলার ১১ মাসের তথ্য প্রকাশ করলেও সার্বিক আমদানি ব্যয়ের ১০ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে দেখা যায় এই ১০ মাসে পণ্য আমদানিতে সব মিলিয়ে ৫৮ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১৪ দশমিক ৪০ শতাংশ কম।
সবশেষ এপ্রিল মাসে আমদানি ব্যয় কমেছে ৩২ দশমিক ২৩ শতাংশ। এই মাসে ৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। গত অর্থবছরের এপ্রিলে ৭ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছিলেন তারা।
সোয়া বছর বেশি ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলারের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। গত বছরের মার্চে দেশে মার্কিন ডলারের যে সংকট শুরু হয়েছিল, তা এখনো কাটেনি। অনেক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন, পণ্য আমদানিতে তারা চাহিদামতো ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারছেন না। অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে সেবা দিয়ে যে আয় ও মুনাফা করেছে, তা-ও নিজ দেশে নিতে পারছে না।
বাজারে চাহিদা বাড়লেও জোগান কমছে ডলারের। আর এতে আন্তঃব্যাংক লেনদেনে এই বিদেশি মুদ্রার দর অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে ১০৯ টাকায় উঠেছে।
এক বছর আগে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিনিময় হার বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ।
প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখতে দুই বছর ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে চলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছিল। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বৃহস্পতিবার পর্যন্ত (১১ মাস ১৫ দিনে) সাড়ে ১৩ বিলিয়ন ডলারের মত বেশি বিক্রি করা হয়েছে।
তবে সব ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে না বাংলাদেশ ব্যাংক। শুধু সরকারের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা সারতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করা হচ্ছে।
চলতি বছর মার্চ থেকে মে-এই তিন মাসে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ৩৬ শতাংশ। এপ্রিল মাসে এলসি খোলা হয়েছিল ৪ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার। মার্চে খোলা হয়েছিল ৫ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলারের এলসি। ফেব্রুয়ারিতে খোলা হয়েছে ৫ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলার।
রোজার মাসে ভোজ্যতেল, চিনিসহ আরও কিছু পণ্যের চাহিদা বাড়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে পণ্য আমদানির এলসি খোলা বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এর দুই মাস আগেও জানুয়ারি, ডিসেম্বর ও নভেম্বরে এলসি খোলার পরিমাণ কমিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। জানুয়ারিতে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলার, ডিসেম্বরে ৫ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার এবং নভেম্বরে ৪ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছিল।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রিজার্ভ কমে গেছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চেষ্টা করছে যত কম এলসি খোলা যায়। এতে রিজার্ভ ধরে রাখতে চাইছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। ফলে এতে বোঝা যায়, দেশে এখনো ডলারসংকট কাটেনি। ইন্টার ব্যাংকে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে এলসি খোলা কমেছে, ফলে আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে এলসি নিষ্পত্তির পরিমাণ আরও কমবে।’
তিনি বলেন, “এলসি খোলা কমানোর প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতির ওপর। কারণ, মূলধন যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামালসহ আরও প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি কমেছে। এর ফলে দেশে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প উৎপাদন কমে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।”
আশার কথা হচ্ছে, চলতি মাসেই চার দাতা সংস্থার ১ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারের ঋণ রিজার্ভে যোগ হবে। তখন রিজার্ভ হয়ত ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। কিন্তু আগামী জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে।
মার্চ-এপ্রিল মেয়াদে আকুর ১ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছিল। এবার যদি ১ বিলিয়নও করতে হয়, তাহলে কিন্তু রিজার্ভ সেই আগের অবস্থায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসবে।
চার উন্নয়ন সংস্থার মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক দিচ্ছে ১৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি দেবে ৪০ কোটি ডলার। একই পরিমাণ (৪০ কোটি ডলার) ঋণ দিচ্ছে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক-এআইআইবি।
এই তিন সংস্থার সঙ্গে সরকারের ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। আরেক উন্নয়ন সংস্থা জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি-জাইকার সঙ্গেও দুই-একদিনের মধ্যে ২১ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঋণের চুক্তি সই হবে বলে জানিয়েছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
কমেন্ট