আমদানি বাড়ছে, ৬ মাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয় মে’তে
মে মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। প্রতীকী ছবি
ডলার সংকটের ও নানা কড়াকড়ির মধ্যেও আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সবশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত মে মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন (৫৯৮ কোটি ৪০ লাখ) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা।
এই অঙ্ক আগের মাস এপ্রিলের চেয়ে ২৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি। আর গত ছয় মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এপ্রিল মাসে ৪৮৪ কোটি ২০ লাখ (৪.৮৪ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
ছয় মাস আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে ৭৫৯ কোটি ১৬ লাখ (৭.৫৯ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছিলেন ব্যবসায়ীরা। এর পর গত মে পর্যন্ত প্রতি মাসেই আমদানি খাতে খরচ ৬ বিলিয়ন ডলারের কম ছিল।
আমদানির এই হিসাব অবশ্য ফ্রি অন বোর্ড বা এফওবি-ভিত্তিক। এর মানে হলো- আমদানির জন্য পণ্য জাহাজে তোলার পর পণ্যের যে মূল্য, সেটাই বিবেচ্য। আর তাই আমদানির কস্ট অ্যান্ড ফ্রেইট বা সিঅ্যান্ডএফ মূল্যের সঙ্গে এর পার্থক্য হয়। সিঅ্যান্ডএফ মূল্য হলো প্রকৃত মূল্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়া পণ্যের জাহাজীকরণের খরচ।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার পণ্য আমদানির খরচ বা ব্যয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যায়, ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ১১ মাসে অর্থাৎ জুলাই-মে সময়ে সব মিলিয়ে ৬ হাজার ৪৭৬ কোটি ৪০ লাখ (৬৪.৭৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। যা ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ের তুলানায় ১৪ দশমিক ১১ শতাংশ কম।
এর মধ্যে প্রথম মাস জুলাইয়ে আমদানি হয় ৫ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আগস্টে পণ্য আমদানিতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। সেপ্টেম্বরে তা কিছুটা কমে ৬ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। আক্টোবরে তা আরও কমে নেমে আসে ৬ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে।
পরের মাস নভেম্বরে তা এক লাফে বেড়ে ৭ দশমিক ৫৯ বিলিয়নে উঠে। ডিসেম্বরে অবশ্য তা কমে ৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।
চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে আমদানি খাতে খরচ হয় ৫ দশমিক ৮১ বিলিয়ন ডলার। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে তা কমে ৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়নে নেমে আসে। মার্চ মাসে পণ্য আমদানিতে ব্যয় হয় ৫ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার।
এপ্রিল ও মে মাসে ব্যয় হয় যথাক্রমে ৪ দশমিক ৮৪ বিলিয়ন ও ৫ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার।
২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে মোট ব্যয় হয়েছিল ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে পণ্য আমদানিতে সবচেয়ে বেশি খরচ।
২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে ওই ব্যয় ছিল ৩৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি।
বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। এই রিজার্ভ ফের ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
গত বুধবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার। বৃহস্পতিবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মে-জুন মেয়াদের ১ দশমিক ১ বিলিয়ন (১০৯ কোটি ৬০ লাখ) ডলার পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ২৯ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে ‘গ্রস রিজার্ভ’ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার থাকলেও বিপিএম৬ (ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন) পদ্ধতিতে হিসাব করলে এই রিজার্ভ দাঁড়ায় ২৪ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার।
এ হিসাবে মে মাসে ৬ বিলিয়ন ডলার আমদানি খরচ হিসাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্রস রিজার্ভ’ দিয়ে ছয় মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। আর বিপিএম৬ পদ্ধতিতে হিসাব করলে বর্তমানের রিজার্ভ দিয়ে চার মাসের কিছু বেশি সময়ের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রা মজুত থাকতে হয়।
আমদানি দায় পরিশোধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টে ঘাটতি দেখা দেয়। সেই ঘাটতি সামাল দিতে গত জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের কাছে ৪৭০ কোটি (৪.৭ বিলিয়ন) ডলার ঋণ পেতে সমঝোতা করে বাংলাদেশ।
ঋণ সমঝোতার পর আন্তর্জাতিক এ সংস্থার পরামর্শ আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনায় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিপিএম৬ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। বাংলাদেশ আইএমএফের সেই পরামর্শ মানতে রাজি হয়।
গত ১৮ জুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতি ঘোষণা সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন, “আইএমএফ সদস্য অন্যান্য দেশগুলো বিপিএম৬-এর ফর্মুলা কার্যকর করেছে। আমরাও সেটা কার্যকর করবো। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাবও থাকবে।”
গভর্নর রউফ তালুকদার বলেন, “আমরা রিজার্ভ থেকে যেসব বিনিয়োগ করেছি সেগুলো ঝুঁকিমুক্ত। আমাদের সব ঋণের গ্যারান্টার রয়েছে। সব টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক ফেরত পাবে। শ্রীলংকার লোনও আমরা ফেরত পেতে পারি তাদের স্থানীয় মুদ্রায় সমন্বয়ের মাধ্যমে।”
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ব্যাংক মোট রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করে আসছিল। কিন্তু বেশ কিছুদের ধরে আইএমএফ এই হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। তাদের যুক্তি, বাংলাদেশ ব্যাংক মোট যে রিজার্ভের হিসাব দিচ্ছে, তাতে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ), শ্রীলঙ্কাতে দেওয়া ২০ কোটি ডলার ঋণসহ অন্য কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগকে অন্তর্ভুক্ত দেখানো হচ্ছে।
আইএমএফ বলছে, এটা রিজার্ভের নিট বা প্রকৃত হিসাব নয়। কেননা, এই মুহূর্তে প্রয়োজন হলে বাংলাদেশ সরকার রিজার্ভ থেকে যে অর্থ অন্য খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে বা ঋণ দেয়া হয়েছে, তা ব্যবহার করতে পারবে না।
আপৎকালীন সংকট মোকাবিলার জন্য রিজার্ভের যে অর্থ তাৎক্ষনিক খরচ করা যাবে সেটাকেই প্রকৃত রিজার্ভ হিসেবে হিসাব করতে বলে আসছিল আইএমএফ।
এতদিন বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আমলে না নিলেও ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ায় আইএমএফের এই শর্তটি এখন বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হচ্ছে সরকারকে।
আকুর দেনা পরিশোধের আগে প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের মত। আইএমএফের শর্ত ছিল ৩০ জুনের আগে প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলার থাকতে হবে এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আইএমএফের শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ।
সে কারণে সংস্থাটির দ্বিতীয় কিস্তির ৬০ কোটি ডলার পেতে সমস্যা হবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক পরিষি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
এআরএইচ ডটকমকে তিনি বলেন, “আশার কথা হচ্ছে কোরবানির ঈদের কারণে জুন মাসে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে। রপ্তানি আয়ও ওই মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। সে কারণেই রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের উপরে উঠেছিল। আকুর বিল শোধের পর তা আবার ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে।”
“এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাবে রিজার্ভ যাতে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে না নামে আর আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম৬ হিসাবে ২৫ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থান কারে-সেটা নিশ্চিত করতে হবে।”
“আর এ জন্য রপ্তানি আয় ও রেমিটেন্স বাড়ানোর পাশাপাশি দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কম সুদের ঋণ-সহায়তার পাওয়ার জন্যও জোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে,” দীর্ঘদিন আইএমএফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান মনসুর।
কমেন্ট