রুপিতে লেনদেন যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ-ভারত
অবশেষে ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেন শুরু হলো। মঙ্গলবার বহুল প্রতিক্ষিত এই লেনদেনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোদন করা হয়। ছবি: এআরএইচ ডটকম
প্রতিবেশি দুই দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। অনেক আলোচনার পর অবশেষে ভারতের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হলো; শেষ হলো বহুল প্রতিক্ষিত এই দিনের অপেক্ষা।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর লো মেরিডিয়ান হোটেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ভারতীয় হাইকমিশনের যৌথ আয়োজনে এক অনুষ্ঠানে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে রুপির ব্যবহার শুরুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়।
দেড় বছর ধরে চলা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক সময়ের ডলার সংকট দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনায় থাকা বিকল্প এ লেনদেন মাধ্যমকে এবার বাস্তব রূপ দিল।
প্রতিবেশী দেশ দুটির মধ্যে ডলারের মাধ্যমে এতদিন ধরে চলা বাণিজ্যিক লেনদেনে এবার যুক্ত হলো রুপি।
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা বলেন, “শেষ ১০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এই সম্পর্কের ভিত আরও মজবুত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে রুপিতে লেনদেন শুরু হওয়ার মাধ্যমে বানিজ্য আরও বাড়বে।”
“এতে দুদেশেরই বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভের উপর চাপ কম পড়বে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুল রউফ তালুকদার বলেন, “বাংলাদেশ ভারতে ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে। তবে রুপির মাধ্যমে বাণিজ্য শুরু হয়ায় তা অনেকগুণ বেড়ে যাবে বলে আমি আশা করছি।”
প্রথমে ভারতীয় মুদ্রায় লেনদেন শুরু হলেও পরবর্তী সময়ে এ সুবিধা মিলবে টাকাতেও। এতে বৈদেশিক মুদ্রায় চাপ কমবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি অনেক। এমন উদ্যোগের সুফল নিয়ে ব্যবসায়ী এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। বলা হচ্ছে, রুপি আন্তর্জাতিক মুদ্রা নয়, এর ফলে ভারতীয় মুদ্রার চাহিদা বাড়বে, শক্তিশালী হবে রুপি।
তবে কেউ কেউ বলছেন, ডলারের আধিপত্য কমিয়ে আনতে এটি একটি পদক্ষেপ মাত্র। ভবিষ্যতে টাকাতেও লেনদেনের উদ্যোগ নিতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার হচ্ছে অন্যতম প্রধান মুদ্রা। ব্যতিক্রম ছাড়া বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ এত দিন ডলারেই দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য করে আসছে।
ব্যতিক্রমের মধ্যে যেমন চীনা মুদ্রা ইউয়ানে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারেন। ভারত অবশ্য ডলারের পাশাপাশি নিজস্ব মুদ্রা রুপিতে অনেক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছে আগেই।
পাশের দেশটি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে শুরু করল রুপিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য।
ভারতের সঙ্গে মার্কিন ডলারে লেনদেনের বিদ্যমান ব্যবস্থার পাশাপাশি রুপিতে লেনদেন শুরু হলো। তবে রুপিতে যে পরিমাণ রপ্তানি আয় হবে, শুধু সমপরিমাণ আমদানি দায় মেটাতে ভারতীয় এ মুদ্রা খরচ করা যাবে।
কোনো ব্যাংক বা ব্যবসায়ী ডলার কিংবা অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে রুপি কিনে আমদানি দায় নিষ্পত্তি করতে পারবে না।
বাংলাদেশ অংশে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক, বেসরকারি ইস্টার্ন ও স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে এ বাণিজ্য হবে। ভারতের অংশে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং আইসিআইসিআই ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন হবে।
এ বিষয়ে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “রুপিতে লেনদেন চালুর বিষয়ে আমরা এরই মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করেছি। স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও আইসিআইসিআই ব্যাংকে হিসাব খোলা হয়েছে। এই দুই ব্যাংকের সঙ্গে সুইফট কমিউনিকেশন সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এখন কোনো ব্যবসায়ী চাইলে রুপিতে এলসি খুলতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “ভারতে বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের মতো রপ্তানি করে বাংলাদেশ। দেশটি থেকে আমদানি হয় ১৪ বিলিয়ন ডলারের মতো। এখন এ দুই বিলিয়ন ডলারও যদি রুপিতে নিষ্পত্তি করা যায়, তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমবে। এ ছাড়া আগামীতে রপ্তানি আরও বাড়াতে পারলে তখন সুযোগ বাড়বে।”
ভারতের সঙ্গে কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা বা নিজস্ব মুদ্রা বিনিময়ের মাধ্যমে উভয় দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করার আলাপ চলছে প্রায় এক দশক ধরে। ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রা এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য পরিচালনা করে, আর্থিক পরিভাষায় একে বলা হয় ‘কারেন্সি সোয়াপ ব্যবস্থা’।
এ ব্যবস্থায় অর্থাৎ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করতে বাংলাদেশের সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক ভারতের স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই) এবং আইসিআইসিআই ব্যাংকে হিসাব খুলেছে। এ হিসাবের নাম নস্ট্র হিসাব।
এক দেশের এক ব্যাংক অন্য দেশের কোনো ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের উদ্দেশে হিসাব খুললে সে হিসাবকে নস্ট্র হিসাব বলা হয়ে থাকে। একইভাবে বিদেশের কোনো ব্যাংক যদি বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে একই উদ্দেশে হিসাব খুলে থাকে, তাকে বলা হয় ভস্ট্র হিসাব।
ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “আপাতত ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য হবে। পরে বাংলাদেশি টাকার বিষয়টিও আসবে বলে আমরা আশা করছি।”
আপাতত ভস্ট্র হিসাব খোলার দিকটি বিবেচনায় থাকছে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রগুলো জানায়। রুপির পাশাপাশি বাংলাদেশি মুদ্রা টাকাও যখন দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হবে, তখন ভস্ট্র হিসাব খোলার বিষয়টি আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৯১৬ কোটি (৮৯.১৬ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি (১৩.৬৯ বিলিয়ন) ডলারের পণ্যই আমদানি হয় ভারত থেকে।
একই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি (প্রায় ২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য। আমদানি-রপ্তানি মিলিয়ে উভয় দেশের মধ্যে ১ হাজার ৫৬৮ কোটি ডলারের (১৫.৬৮ বিলিয়ন) বাণিজ্য হয় ওই অর্থবছরে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরেও দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের একই প্রবণতা রয়েছে।
বিষয়টি কীভাবে গতি পেল
কোভিড ও পরে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও ডলার-সংকট দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামলাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এ অবস্থায় ভারতের দিল্লিতে গত বছরের ডিসেম্বরে যখন দুই দেশের বাণিজ্যমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়, তখনই ভারতের পক্ষ থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা ও ভারতীয় মুদ্রা রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দেওয়া হয়।
এরপর ভারতের বেঙ্গালুরুতে গত ২৪-২৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জি-২০ভুক্ত দেশগুলোর অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরদের সম্মেলনের এক ফাঁকে দুই দেশের গভর্নরদের একটি বৈঠক হয়। উভয় গভর্নরই কাজটি দ্রুত করার বিষয়ে একমত হন।
রুপিতে লেনদেনের প্রভাব কী
বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত মুদ্রা নয় ভারতীয় রুপি। আবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি। ফলে রুপিতে লেনদেনে বাংলাদেশ কোনো ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে কি না—এমন প্রশ্নও রয়েছে। প্রক্রিয়াটি শুরু হলে পণ্য বাণিজ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ব্যবহার হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ১৮ জুন মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় বলেই দিয়েছেন, টাকার পাশাপাশি রুপিতে ব্যবহার করা যাবে, পে কার্ড নামে এমন একটি ডেবিট কার্ড নিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশিরা ভারতে ঘুরতে গিয়ে এ কার্ড দিয়ে লেনদেন করবেন এবং কার্ডটি চালু হলে বাংলাদেশিদের ডলার খরচ কমবে। গভর্নরের মতে, কেউ ভারতে গেলে ভ্রমণকারীর ১২ হাজার ডলারের যে ভ্রমণ কোটা আছে, সে পরিমাণ অর্থ তিনি রুপিতে কেনাকাটা করতে পারবেন।
কমেন্ট