লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি কমেছে, স্বস্তি ফিরছে
২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর।
সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় প্রায় ১৬ শতাংশ কমে ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষ হয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পাশাপাশি রপ্তানি আয়েও ইতিবাচক ধারা ছিল। আর এর ফলে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের (ব্যালান্স অব পেমেন্ট) ঘাটতি। বাণিজ্য ঘাটতি নেমেছে অর্ধেকে।সব মিলিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্যের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করেছে। তাতে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন (৩৩৩ কোটি ৪০ লাখ) ডলার।
আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ১৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ২০২১-২২ অর্থবছর। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনোই কোনো অর্থবছরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে এত ঘাটতি দেখা যায়নি। তার আগের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২০-২১ অর্থবছরে এই সূচকে ৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি ছিল।
অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে আমদানি ব্যয় কমেছে ঠিকই। এদিক দিয়ে সরকার সফল হয়েছে বলা যায়। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহও ইতিবাচক ধারায় আছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ কিন্তু অনেক কমে গেছে। দেড় বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘গ্র্রস’ হিসাবের রিজার্ভ কিন্তু ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।”
“ডলার সংকট এখনও রয়ে গেছে। এ অবস্থায় রিজার্ভ যদি আরও কমে যায়, তাহলে কিন্তু বিপদ আছে। তাই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স আনতে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। একইসঙ্গে রপ্তানি আয় ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে কম সুদের বিদেশি ঋণ ও এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) বাড়াতেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।”
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষ পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়েও উল্লম্ফন হয়েছিল; ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।
গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে অর্থনীতির বিশ্লেষক বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর এআরএইচ ডটকমকে বলেন, “ব্যালান্স অব পেমেন্টে ঘাটতি কমে এলে অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে। ডলারের বাজারেও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু আমদানি ব্যয় বেশ কমার পরও কিন্তু ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঘাটতি রয়ে গেছে।”
“এখানে আরেকটি বিষয় আছে, আমদানি কমলে কিন্তু দেশে বিনিয়োগ কমে যাবে। কর্মসংস্থান হবে না। অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কাঙ্খিত জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে না। তবে, আমি মনে করি, জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার দিকেই এখন সরকারের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিৎ।
“বর্তমান বিশ্ব পেক্ষাপটে চলতি অর্থবছরে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধিও যদি অর্জিত হয়, তাও সেটা যথেষ্ট বলে বলে আমি মনে করি।”
বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।
বাণিজ্য ঘাটতি অর্ধেকে নেমেছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ রপ্তানির চেয়ে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি করেছে।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল এর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ, ৩৩ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। শতাংশ হিসাবে গত অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ কমেছে ৪৮ দশমিক ৪১ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরের সব মিলিয়ে ৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ কম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮২ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অন্যদিকে গত অর্থবছরে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৫২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছেন রপ্তানিকারকরা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬ দশমিক ২৮ শতাংশ বেশি। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য রপ্তানি থেকে ৪৯ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছিল।
এ হিসাবেই ২০২২-২৩ অর্থবছরের পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
রেমিটেন্স বেড়েছে ২.৭৫ শতাংশ
২০২১-২২ অর্থবছরে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কম। তবে এবার এই সূচকে উল্লম্ফন নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছিল। অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে ৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১২ দশমিক ২৫ শতাংশ বেশি।
কিন্তু সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়। ওই দুই মাসেই দেড় বিলিয়ন ডলার করে রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অথচ প্রথম দুই মাসে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি করে পাঠিয়েছিলেন।
তবে নভেম্বর থেকে রেমিটেন্স ফের বাড়তে শুরু করেছে। নভেম্বরে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার পাঠান প্রবাসীরা। ডিসেম্বরে আরও বাড়ে, ১৭০ কোটি ডলার এসেছে। জানুয়ারিতে আসে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার, ১৯৬ কোটি ডলার।
মার্চ মাসে ২ বিলিয়ন ছাড়িয়ে ২ দশমিক শূন্য দুই বিলিয়ন ডলার আসে। অর্থবছরের শেষ মাস জুনে আসে ২ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার।
সব মিলিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স দেশে এসেছে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
সেবা বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়েছে
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার।
মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি খাতের আয়-ব্যয় হিসাব করে সেবা খাতের বাণিজ্য ঘাটতি পরিমাপ করা হয়।
সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি ৮.২২ বিলিয়ন ডলার
সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে (ওভারঅল ব্যালান্স) ৮ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের বড় ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছে ২০২২-২৩ অর্থবছর। আগের অর্থবছরের এই ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।
অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরে ওভারঅল ব্যালান্সে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।
আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি
আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি নিয়েই শেষ হয়েছে অর্থবছর। ২০২২-২৩ অর্থবছর শেষে আর্থিক হিসাবে (ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট) ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলার। ১৫ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছিল।
তার আগের অর্থবছরের ১৪ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্ত ছিল।
করোনা মহামারির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ অন্য দাতা দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত ঋণসহায়তা পাওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে আর্থিক হিসাবে বড় উদ্বৃত্ত ছিল বলে জানান আহসান মনসুর।
নিয়মিত আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য আয়-ব্যয় চলতি হিসাবের অন্তর্ভুক্ত। এই হিসাব উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়।
কমেন্ট